|
|
|
|
|
|
|
জাস্ট যাচ্ছি |
শুভময় মিত্র
|
শাটার ভাঙা জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে ছোট-ছোট কয়লার কুচি মুখে এসে লাগছিল। চোখ করকর করতেই আমাকে জোর করে তুলে দেওয়া হল ওপরের খালি বাঙ্কে। সেখানে কারুর ফেলে যাওয়া চিনে বাদাম ভেঙে ভেঙে খেতে শুরু করলাম। ফাঁক-ফাঁক কাঠের পাটাতন লাগানো বাঙ্কের ফোকর দিয়ে খোলা আর ঝাল-নুন ফেলতে লাগলাম যারা নীচে বসে আছে, জড়োসড়ো হয়ে, চাদর মুড়ি দিয়ে, লম্বা বিড়ি খাচ্ছে তাদের মাথায়। কিন্তু ওরা কিছু বুঝতেই পারছিল না। একটু পরেই জিজো আর বুম্বা ‘রায় এসে গেছে, রায় এসে গেেছ, এর পর খালারি, তার পরের স্টেশনেই নামতে হবে, মাত্র দু’মিনিট দাঁড়াবে, মাল নামাও, মাল নামাও’ বলে মহা চেঁচামেচি। বড়কাখানা থেকে ট্রেনে চেপেছি সবাই। ট্রেনটা যাবে ডালটনগঞ্জ পর্যন্ত। আমরা নেমে পড়ব মাঝখানে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বাবা বলল, ‘খালারিতে সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আছে।’ সুটকেস, হোল্ড-অল টেনে-হিঁচড়ে নামানো হল প্ল্যাটফর্মে, কিন্তু প্ল্যাটফর্ম তো নেই। অনেক নীচে স্রেফ বাঁধানো একটা উঠোন। কামরার দরজার রেলিং ধরে নেমে পড়ার পর অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল লাল রঙের পুরনো ট্রেনটা। অনেক লোক নামল, উঠল কেউ কেউ, কিন্তু এরা কেউই আমাদের মতো নয়। কাঁচা শালপাতায় ছোলা-লঙ্কা বিক্রি হচ্ছিল, আমি চাইতে সাহস পেলাম না। সবাই ভাঁড়ে চা খেল। চার দিকে হইহল্লা হচ্ছিল। তারপর এক বার হুইস্ল বাজিয়ে, ভঁস ভঁস ঘটাং ঘটাং করে ট্রেনটা চলে যেতেই চারদিক চুপচাপ হয়ে গেল। শুধু কয়েকটা শুকনো হলুদ পাতা খড়মড় করে উড়ে বেড়াতে লাগল আশপাশে। মীরামাসি বলল, ‘এই রে, মালগাড়ি পড়ে গেছে, পেরোব কী করে?’ ডাইনে বাঁয়ে যে দিকেই তাকাই মালগাড়িটা শেষ হয় না।
মায়ের বন্ধু মীরামাসির বাড়ি আছে এখানে। তাই এসেছি সবাই। একতলা বাড়ি, টালির চাল, পুরনো সায়েব-সায়েব গন্ধ আছে একটা। উঠোনের দু’পাশে বাঁধানো বসবার জায়গা আছে। কুয়ো আছে। আগে বাগান ছিল বোধ হয়, এখন জঙ্গল হয়ে গেছে। ওখানেই এসে রোদে বসল পিটার। ডেচকিতে শুয়োরের মাংস আছে। দাঁড়িপাল্লা বেরোল, কিন্তু বাটখারা নেই, কয়েকটা ছোটবড় পাথর আছে। ‘ভিন্দালু হবে, ভিন্দালু হবে’ বলে লাফাতে লাফাতে জিজো আর বুম্বা ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়ল, পিছন পিছন আমিও। এক্ষুনি একটা নতুন খেলা আবিষ্কার হবে। ওখান থেকেই সবার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। কে যেন বলল, ‘এখানে বুদ্ধদেব গুহ-র বাড়ি আছে না?’ অমনি এক জন বলল, ‘না, না, অপর্ণা সেন।’
ফাঁকা জায়গা, প্রচুর গাছপালা, একটু দূরে টিলাও দেখা যাচ্ছে। লাল কাঁকর-ভরা মাটি, পিচ উঠে যাওয়া রাস্তা। কাদের যেন ছাগল, মুরগি। শুকনো ডালপালা মাথায় নিয়ে চলতে থাকা মেয়ে বুড়ো। আর কিছুই নেই এখানটায়। কলকাতার চেয়েও ঠান্ডা বেশি, তাই সারা দুপুর দৌড়োদৌড়ি করেও ঘাম হচ্ছিল না। ত্রিদিবমেসোর গলা শুনলাম, ‘মিস্টার লাহিড়ির বাড়ি যাওয়া যাক, চা-টা ওখানেই হবে।’ সবাই বেরনো হল।
মস্ত লোহার গেটের ওপাশে দুটো ভয়ংকর কুকুর দৌড়ে এসে চিৎকার শুরু করল। ভেতরের বাগান থেকে গলা শুনলাম, ‘স্টপ ইট’। ওদের বকলস ধরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর আমরা ঢুকলাম। আমাকে ভয় পেতে দেখে মিস্টার লাহিড়ি যেন মজা পেলেন। বললেন, ‘কী কুকুর জানো? ল্যাব্রাডর। কী বললাম? ল্যাব্রাডর।’ ওঁর বসার ঘরে চা খেতে খেতে দেখলাম দেওয়ালে খুব সুন্দর দেখতে ছোট্ট একটা পাখিকে ছবির মতো ঝোলানো রয়েছে। মিস্টার লাহিড়ি বললেন, ‘ওটা বার্ড অফ প্যারাডাইস।’ আরও নানারকম কথা হচ্ছিল, অনেকটাই ইংরিজিতে। বুঝতে পারছিলাম না, ভালও লাগছিল না। কিন্তু বাইরের বাগানে যেতে সাহস হচ্ছিল না, কারণ ল্যাব্রাডর আছে। |
|
ছবি: শুভময় মিত্র |
মা আর মীরামাসি দুপুরের রোদে পিঠ দিয়ে হাসতে হাসতে গল্প করতে করতেই কাটিয়ে দিল। বাবা আর ত্রিদিবমেসো কোনও এক অ্যাংলো পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাদের কাছ থেকে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড মেড ইন অস্ট্রিয়া কালো কোট কিনে আনল। নিশ্চয়ই সস্তা। বাবা বারবার বলতে লাগল, ‘কাট্খানা দ্যাখো, কাট্।’ এই জায়গাটায় আগে নাকি অনেক অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা থাকত, এখন বেশির ভাগই চলে গেছে অস্ট্রিয়ায়। এক-আধ জন যারা আছে, তাদের অনেক বয়েস হয়ে গেছে, কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।
সারা দিন খেলা, ছাগল ধরা। সন্ধের পর এত ঠান্ডা লাগত, বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকে মোজা পরে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে বড়দের গল্প শুনতাম। রাতে চার পাশ নিস্তব্ধ হয়ে যেত, ঘুমচোখে খাবার খেতে খেতে দূরে শুনতে পেতাম ট্রেনের শব্দ। লাহৌর রেলের ফিশপ্লেটের কাছে চাকার শব্দ শুনে গুনে নিতে শিখে গেলাম কত বগির মালগাড়ি যাচ্ছে। শেষ চাকার শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ঘুম এসে যেত।
যাঁর বাড়িতে যাওয়াটা কিছুতেই আমাদের হয়ে উঠছিল না, তিনি রাঁচি থেকে ফিরে এসেছেন শুনেই হইহই করে সবাই বেরিয়ে পড়ল। তাঁর নাম শুনলাম রেভারেন্ড প্রসেনজিৎ বিশ্বাস। আমাদের বাড়ির চেয়েও পুরনো বাড়ি, বাগানভর্তি জঙ্গলে ঢোকা অসম্ভব। তিন ধাপ সিঁড়ির উপর থেকে ‘আরে এসো এসো, কবে এলে, এ বারে থাকছ তো’ বলতে বলতে নেমে এলেন চেক-চেক শার্ট আর গল্ফক্যাপ পরা হাসিখুশি এক জন বুড়ো মানুষ। বললেন, ‘চলো বাথরুম দেখাই।’ ভয়ানক অবাক হয়ে সবাই গেল, তারপর হাসিতে ফেটে পড়ল। একটা দেওয়ালে মস্ত ওয়ালপেপার লাগানো, তাতে একটা ছবি। দেওয়ালটা যেন হঠাৎ ফেটে ভেঙে পড়েছে, বাইরে সমুদ্রের ধার, আর এক মোটা মেমসাহেব সুইমস্যুট পরে, লজ্জা-লজ্জা মুখ করে তাকিয়ে আছে। ‘আমাদের বাড়ির একটা রিচুয়াল আছে, কোনও মহিলা প্রথম বার এলে একটা রুটি কাটতে হয়। তা হলে, আমাদের বিশ্বাস, ঘরে অন্নের অভাব হয় না।’ বলা হল মা’কে। প্লেট, একটা আস্ত বান রুটি, ছুরি সাজানোই ছিল, মা এগিয়ে গেল। কাটতে যেতেই খটাং করে আওয়াজ, মা-র হাত থেকে ছুরি ছিটকে পড়েছে মাটিতে, মা ভয়ানক অপ্রস্তুত। সবাই প্রবল হাসছে। বোঝা গেল এটা পুরনো খেলা। হাত দিয়ে দেখি, রুটি নয়, ওটা আস্ত পাথর। দেখে বোঝার উপায় নেই, এমনকী আধপোড়া দাগটাও আছে। হইহই হল অনেক ক্ষণ ধরে, হাসি-গল্পের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল গত ক্রিসমাসের পার্টিতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কোন কোন সম্মানিত লোক অন্যের স্ত্রী সম্পর্কে কী কী বলে ফেলেছেন। বেরনোর পরে মীরামাসি বলল, ‘স্যাড ব্যাপার আছে একটা, ব্যাচেলরই রয়ে গেলেন চিরকাল।’
ফেরার দিন সকালে এক দল লোক এল, কী-সব চাইছিল, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একই কথা বলছিল। ত্রিদিবমেসো ওদের টাকা দিল কিছু। বলল, ‘এখানে তো ব্লাড নেই, এখানে তো ব্লাড পাওয়া যায় না, পেশেন্টকে ডাল্টনগঞ্জ নিয়ে যাও।’ আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না এখানে কারুর কাছে কোনও ব্লাড নেই কেন। বুঝতে পারছিলাম না ওরা আমাদের ব্লাড চাইতে এসেছিল কেন।
বুঝতে পারার অনেক বছর পরে আবার এক দিন ম্যাকলাস্কিগঞ্জ স্টেশনে নামলাম শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস থেকে, মাঝরাতে। প্ল্যাটফর্মটা আগের মতোই নিচু। চারপাশ খাঁ-খা।ঁ চেঞ্জ বলতে লাল ট্রেনটা নীল হয়ে গেছে। কেউ আজকাল আসে না তেমন। আগুন জ্বলে গেছে জঙ্গলে, কারা যেন মেরে ফেলেছে অনেক মানুষকে। অনেকেই হারিয়ে গেছে, আর ফিরে আসেনি।
আমার কিছু করার ছিল না, তাই অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ। নজর পড়ল চকচকে রেললাইনে। সেখানে সিগন্যালের লাল আলো পড়ে চকচক করছে। মনে হল, এক দিগন্ত থেকে আর এক দিগন্ত পর্যন্ত পর পর তরোয়াল পড়ে আছে। তাতে টাটকা রক্ত। |
|
|
|
|
|