|
|
|
|
|
|
|
এবং বেওয়ারিশ |
দু’টি মেয়ে আত্মহত্যা করে নন্দীগ্রামের মাঠে, তারা প্রেমিকা। সমকামী।
তাদের মৃতদেহ অবধি মর্গে নিতে যাননি বাড়ির লোক।
দেবলীনা
|
এই দুনিয়ায় মানুষ আমাদের ভালবাসা কোনদিন মানতে চায় না।... আমরা একে অপরকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না, তাই আমাদের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের ভগবান কোনদিন ক্ষমা করবে না... তোমরা সবাই ভালো থাকো সুখে থাকো।... ভাই, দুজন যদি একসাথে মরি দুজনকে এক জায়গায় রাখিস সেটা যে খানে হোক... আর যদি বেঁচে থাকি অনেক দূর চলে যাবো, অনেক দূর, আর ফিরবো না...’
কখনও এত কাছ থেকে দেখিনি কোনও সুইসাইড নোট। আসলে কাছ থেকে কেন শুধু, এর আগে মুখোমুখি হইনি মৃত্যুমুহূর্তের আগে লেখা কোনও অক্ষর-শব্দ-বাক্যের। যত্ন করে প্রতিটি পাতায় ক্রমসংখ্যা দেওয়া। ১, ২, ৩... সংখ্যা পৌঁছয় ছয়ে। চিঠির নাম সে দিয়েছে ‘আমার জীবনী’। ‘ও আমায় খুব ভালবাসে, আমিও ওকে খুব ভালবাসি, নিজের জীবনের থেকেও, কিন্তু কেন তা জানি না।... ওকে বিয়ে দিয়েছিল মারধর করে।... অনেক কষ্ট যন্ত্রণা দিয়ে আমার নামে বাজে বাজে কথা বলে... লোক ডেকে সবার সামনে আমায়, আমার পরিবারকে অসম্মান করে, দিনের পর দিন ওরা আমার উপর অত্যাচার করে, যা মানুষ হয়ে সহ্য করার মতো নয়।... মরে যাওয়া ভাল।... আমার পরিবারের সবাই খুব ভালবাসে আমাকে... ওদের না যেন ক্ষতি হয়।... আমায় ক্ষমা কর মা, বাবা, তোমাদের দুঃখ দিলাম বলে, আমি আমার ভালবাসাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না,...ভাই তোরা বাবা মাকে দেখিস, ওদের কোন কষ্ট দিবি না, দিদিদের দেখিস, আমার উপর কোন রাগ রাখিস না, তোদের উপর আমার কোন রাগ নেই।...’ ফুলস্ক্যাপ কাগজে গোটা গোটা অক্ষর, আমার তথ্যচিত্রসন্ধানী ডিজিটাল যন্ত্র মনখারাপের সন্ধে-আলোয় ছবি তোলে স্বপ্নার মৃত্যু-চিঠির। এই তো সে দিন গেল ভ্যালেন্টাইন’স ডে, ১৪ তারিখের প্রেম দিবস, জানত কি ওরা? ওরা চলে গেল তার এক সপ্তাহের মধ্যে, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১১। স্বপ্না মণ্ডল, সুচেতা মণ্ডল। যুগল আত্মহত্যা। বিষ খেয়ে। কীটনাশক। গ্রামের এক প্রান্তে যে মাঠে বীর হনুমানের মেলা চলছিল, সেই মেলার মাঠে ভোররাত্তিরে ওদের যুগল দেহ পাওয়া যায়। নিজের বাড়িতে গ্রামের কিছু ছেলেমেয়েকে পড়াত স্বপ্না, টিউশন। সুচেতা বিবাহিত ছিল। মাত্রই কিছু দিন আগে ওর বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু মরল ও, আর একটি মেয়ের হাত ধরে, স্বেচ্ছামৃত্যু। যে মেয়ে ওকে কখনও পড়াত। যে মেয়ে হয়তো ওর তুতো-বোনও ছিল। স্বপ্না তেইশ, সুচেতা উনিশ, বা বড়জোর কুড়ি। দু’জনে কোমরে বেঁধেছে একটাই গামছা, হাতে হাত ধরা, স্বপ্নার পরনে ভাইয়ের জিন্স, সুচেতার চুড়িদার। গ্রামের মানুষ বলছিলেন, ‘এমন সুন্দর ভাবে শুয়ে আছে দেখলে আপনিও বলবেন এরা কিছুতেই বিষ খেয়ে মরতে পারে না। কী সুন্দর দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে।’ কথা বলে চলেছি, অথচ তখনও বুঝিনি, যে মানুষগুলো এত মমতা নিয়ে ওদের কথা বলছেন, তাঁরাই একাধিক সালিশি সভা ডেকেছিলেন ওদের যথোপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য। দুই মেয়ের ‘আপত্তিকর’, ‘নোংরা’ মেলামেশা তাঁদের গা গুলিয়ে দিয়েছিল এতটাই যে তাঁরা হুকুম জারি করেছিলেন কিছুতেই যেন ওরা দেখা না করতে পারে এবং ওদের যেন খুব শিগগিরই বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। যে কোনও গ্রামের যে কোনও মায়ের মতো দেখতে স্বপ্নার মা, ওর বাবা। খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি দিনের কঠিন জীবনের আঁকিবুকি ওঁদের চোখেমুখে, শরীরী ভাষার বিপন্নতায়। অথচ বুঝিনি, ঘুণাক্ষরেও আঁচ করিনি, এই আলাপ যখন চলছে, যখন তাঁরা কান্নাভেজা গলায় করছেন ওদের স্মৃতিচারণ, স্বপ্নার মা বলছেন মেয়ের আর কোনও শখ ছিল না, শুধু বেড়াতে যেত যখন বিকেলের আলো ছায়া হয়ে উঠত নদীর ধারে, কী ভাবে সে ছাত্র পড়িয়ে রোজগার করত, পরিবারের সবার জন্য কতখানি মায়া ছিল তার, তখন, ঠিক তখনই, ওদের দু’জনের দেহ পড়ে আছে মর্গের ঘরে, ঠান্ডা, আরও ঠান্ডা, শীতল হয়ে উঠছে ওদের মৃতদেহ, ভালবেসে মরে যাওয়া দুই দেহ-মন, যত ক্ষণ না পুলিশ এই তথ্য দিয়েছে তত ক্ষণ বুঝতে পারিনি, স্বপ্না-সুচেতার দেহ বেওয়ারিশ, কেউ নেয়নি, কেউ নেবে না ওদের, এমনকী ওদের বাবা-মা-ভাই-বোন কেউ না! আমরা তো সারা ক্ষণ দাবি করি, দাবির নেশায় আচ্ছন্ন এই সমাজব্যবস্থায় আমরা নানা ভাবে ‘এইটা আমার’ খুঁটি পুঁতে দিই আমাদের বখরায়, নানাবিধ ঈপ্সায়। এমনকী দুর্বোধ্য, ডিকম্পোজ্ড মৃতদেহের মালিকানা দাবি করতে ডিএনএ টেস্ট করে ফেলি। কিন্তু আমরা কেউ কি ভাবতে পারি, আমার দেহ, আমার এই পরমপ্রিয় আদরের নশ্বর খাঁচাটি, আমার মৃত্যুর পর— আমি স্রেফ অন্য কিছু ভাবতাম বলে, বলতাম বলে, ওই যে জনতার স্রোত কোটিকাল ধরে বয়ে চলেছে তাদের সিংহভাগের মতো করে আমি প্রেম বিষয়টা বুঝতাম না বলে, মেয়ে হয়ে অন্য একটি মেয়েকে ভালবেসেছিলাম বলে কিছু লোক কলার তুলে মর্গের ঠান্ডায় ফেলে দিয়ে চলে গেল, আমার বাবা-মা-ভাই-বোন-বন্ধুকে সৎকার করতে দেওয়া দূরে থাক, কাছেও ঘেঁষতে দিল না! অথবা আমার বাবা, মা, ভাই, বোন, বন্ধু— তারাও এমন দূরে ঠেলে দিল আমাকে যে, আমার এই দেহকে, যাকে তারা এত দিন ধরে লালন করেছে, আদর দিয়েছে, ধমক মার প্রশ্রয় দিয়েছে, তাকে মর্গের ঠান্ডা ঘরটায় বেওয়ারিশ করে ফেলে চলে এল! ঠিক জানি না, সমাজের চাপ কতটা ছিল আর পরিবারের মুখ ফিরিয়ে নেওয়া কতটা। কিন্তু ওদের মৃত্যুর (এটাকে হত্যা বলব না আত্মহত্যা, জানি না) প্রসঙ্গ এতই নিষিদ্ধ, এতই ঘৃণার, উচ্চারণেও যেন ছড়িয়ে পড়বে ভয়ানক ছোঁয়াচে অসুখ কোনও, এমনকী মা, মায়ের সঙ্গে কথা বলেও বোঝা যায় না তাঁর সন্তান সেই মুহূর্তে সৎকারের অপেক্ষায় মর্গে। বেওয়ারিশ লাশ হয়ে! দূরের সুদান, জামাইকা, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা বা ইরানের কোনও গ্রাম শহর নয়, এই বাংলার মায়াভরা বিপ্লবী গ্রাম এক, নন্দীগ্রাম। মেদিনীপুর। |
|
জিয়োভান্নি দা মোদেনা-র প্রখ্যাত ফ্রেসকো ‘ইনফেরনো’ অনুসরণে। ছবি: সুমন চৌধুরী |
স্বাধীনতা আন্দোলন, বামপন্থী আন্দোলন, সাক্ষরতায় বরাবরের প্রথম সারি। যে মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে এই সে-দিন সারা পৃথিবীর কাছে উদাহরণ হয়ে উঠল, সংগঠিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে জনপদ কল্পকাহিনির মতো রুখে দাঁড়াল, সেই এলাকাই দুই মেয়ের প্রেমের প্রশ্নে হয়ে উঠতে পারল চরম ক্রোধী, নির্মম। যে এলাকা আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে একের পর এক জমি খুঁড়ে হাড়গোড়কঙ্কাল বের করে মানুষগুলোর পরিচয় এবং নিজ অধিকার বুঝে নিতে চাইল, তারাই লাশকাটা ঘরে ফেলে রেখে এল সন্তানের সদ্যোমৃত দেহ, মমতাহীন।
তথ্য বলছে এই মুহূর্তে পৃথিবীতে দেশের সংখ্যা ১৯৬। আর এই যে সারা পৃথিবী জুড়ে এত বছরযুগ ধরে সম-অধিকারের জন্য সমকামীদের এত লড়াই, অগুনতি আন্দোলন, অথচ দেখা যাবে রাষ্ট্রের চোখে যে কোনও রকমের বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে আজকের তারিখে মাত্র ন’টি দেশে তারা মুক্ত। অর্থাৎ তাদের বিবাহের অধিকার আছে, দত্তক নিতে পারবে, সমলিঙ্গের মানুষের প্রেমে পড়েছে বলে আইন জেলে পুরবে না বা ফাঁসি দিয়ে দেবে না। কিন্তু সমাজ? সমপ্রেমী বলে, লেসবিয়ান বলে চরম পারিবারিক বা সামাজিক হিংসার মুখোমুখি হওয়া, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এমনকী খুন হয়ে যাওয়াও হয়তো পৃথিবী জুড়েই জলভাত। সেখানে নন্দীগ্রামের সঙ্গে আসন ভাগ করে বসে পড়ে কিরগিজিস্তান, এল সালভাদোর বা ইয়েমেন। এই তো সে-দিন সেনেগালের এক গ্রামে মারা গেলেন সেরিগ্নে মবায়ে, তাঁর সন্তানরা এলাকার বহু কবরখানার দোরে দোরে ঘুরেও বাপের মৃতদেহ গোর দিতে পারল না। গুজব ছিল, ওদের বাবা সমকামী। এই ঘৃণ্য অসুখে আক্রান্ত মৃত শরীরটিকে সুতরাং সবাই দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। সন্তানরা উপায় না পেয়ে এক রাস্তার ধারে মাটি খুঁড়ে বাবাকে কবর দিল। তার পর? প্রশাসন খবর পেয়ে সেরিগ্নের সন্তানদের গ্রেফতার করল, কারণ তারা মৃতদেহকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে সমাধিস্থ করেনি! ধর্ম-সমাজ-রাষ্ট্রের আশ্চর্য আপস! যে আপসে জামাইকার গায়ক এলিফ্যান্ট ম্যান নির্দ্বিধায় হাড়হিমকরা গান বাঁধেন
When you hear a lesbian getting raped
It’s not our fault... Two women in bed
That’s two sodomites who should be dead.
পারিবারিক সমাজিক সম্মান রক্ষার্থে চাবুক মারা, পাথর ছোড়া বা খুন শুধু নয়, চালু হয়ে যায় অদ্ভুত নৃশংস এক পরিভাষা, ‘কারেক্টিভ রেপ’— মূলত নারীর সমকামিতা, তার বিকারব্যাধি দূর করতে পুরুষের মোক্ষম দাওয়াই, সংশোধনমূলক ধর্ষণ! দক্ষিণ আফ্রিকায় এই পরিভাষার উদ্ভব, সেখানকার জাতীয় দলের তারকা ফুটবলার ইউদি সাইমলেন নিজেকে প্রকাশ্যেই সমকামী ঘোষণা করে তোয়াক্কাহীন বাঁচতেন। উচিত শিক্ষা দিতে জোহানেসবার্গের কাছে নিজের শহরে একত্রিশ বছরের নির্ভীক এই মেয়েকে গণধর্ষণ করে খুন করা হয়। আর এই কলকাতা শহরেই তুতো দাদা এবং নিজের দাদা মিলে বোনকে ধর্ষণ করে যায়, অসংখ্য বার! তাদের ছোট বোনের সমকামিতার ওষুধ। পুরুষের ‘স্বাদ’ পেলে তার অসুখ সেরে যাবে। তারা তাকে চুপ করিয়ে রাখে এই বলে যে, যদি সে এই কথা উচ্চারণ করে, তবে তার প্রেমিকার বাড়িতে সব ফাঁস করে দেবে। সদ্য কুড়ি পেরোনো মেয়েটি এক সময় বাধ্য হয় বিয়ে করতে, এবং তার কিছু দিনের মধ্যেই আত্মহত্যা। পবিত্র অকলুষ পরিবার যে কী নৃশংস এক হিংসাভূমি!
আর কত দিন জানা নেই এই বস্তাপচা তথ্যগুলি দিয়ে যেতে হবে যে, দেখুন দাদারা, ১৮৬০ সালে মেকলে নামে যে ইংরেজ সাহেব সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে ভারতীয় দণ্ডবিধির অদ্ভুতুড়ে ৩৭৭ ধারাটি লিখলেন, তাঁর নিজের দেশ ইংল্যান্ড সেই কবে ১৯৬৭ সালেই তা বাতিল করেছে। দিল্লি হাইকোর্ট সমকামীদের পক্ষে ঐতিহাসিক রায় দিলেও এই ধারা এখনও বলবৎ। আর কত দিন ধরে বলতে হবে, ওই যে দেখুন খাজুরাহো বা কোনারক মন্দিরের প্রাচীন দেওয়াল, নাম নিতে হবে জগৎ-আলো-করা কত মানুষের যাঁরা সমকামী, আবারও বলতে হবে, ও দাদা শুনুন, সেই কোন ১৯৭৩ সাল থেকে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন সমকামিতাকে আর রোগ বলে গণ্য করে না, দোরে দোরে সেমিনারে পরিবারে পঞ্চায়েতে আদালতে বলে যেতে হবে কত সে-সব সভ্যতার কথা, যখন সমকামিতাকে দেখা হত মানবজীবনের খুব স্বাভাবিক এক প্রকাশ হিসাবে, অথবা বলতে হবে, প্রাণিজগতেও সমকামিতা যথেচ্ছ বিরাজমান, ব্যাপারটা এতটাই ‘প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আসলে ধর্ম-সমাজ-পরিবার-রাষ্ট্র একটা প্রেমের ম্যাপ যুগ যুগ ধরে এঁকে দিয়েছে তার নানাবিধ ব্যবস্থার বিরাট, হদ্দমুদ্দ অচলায়তনটি টিকিয়ে রাখার জন্য। সেই ম্যাপের বাইরের যে কোনও ভালবাসা, যা নারী-পুরুষ বাইনারির, সাদা-কালো চিন্তার বাইরে: সেই প্রেম-আদর-যৌনতা-সম্পর্কের প্রশ্নে কোথায় যেন আমরা সব্বাই মিলে হাত মিলিয়ে বসি। অসহিষ্ণু, নিষ্ঠুর আমাদের দাঁতনখগুলো বেরিয়ে পড়ে। তখন কী সহজে সন্ধি হয়ে যেতে পারে নিরাপদ-অনড়-অটল ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার নানা নামের, আর সেই সন্ধিচুক্তির তলে চাপা পড়ে যায় স্বপ্না-সুচেতার সেই সুইসাইড নোট, ওদের আর্তি, ‘দুজন যদি একসাথে মরি দুজনকে এক জায়গায় রাখিস সেটা যে খানে হোক...’ এমন আর্জি জানিয়েছিল বনগাঁর কাজলী-অপর্ণা, কেরলের ললিতা-মল্লিকা, গুজরাতের গীতা-কিশোরীও। স্বপ্না-সুচেতা একসঙ্গেই ছিল, হয়তো বা, কারণ দুই পরিবারই ওদের দেহ নিতে কিছুতেই রাজি হয়নি। চিঠির শেষ লাইনে বলা থাকে, ‘বিছানার নীচে সব টাকা আছে, নিয়ে নিও।’ টাকা কেউ নিয়েছিল কি না জানা নেই, কিন্তু দেহ নেয়নি। ওদের দেহ নিয়ম-নির্দিষ্ট প্রশাসনিক অপেক্ষা শেষে পুলিশি হেফাজতে পুড়ে যায়। বেওয়ারিশ হিসেবেই। স্বজনবিহীন, আরও অনেক বেওয়ারিশ লাশের সঙ্গে, হয়তো সেই লাশের ভিড়ে ছিল লালবাতি এলাকায় পাচার হয়ে যাওয়া এই মেদিনীপুরেরই মেয়ে সুজাতা, গ্রামের দুই পুরুষ তাকে পাচার করে, পরে খুন করে, তার পরিবার তাকে নেয় না, সুজাতাও বেওয়ারিশ লাশ হয়, হয়তো ছিল মাওবাদী সন্দেহে ভুয়ো সংঘর্ষে মৃত লালমোহন টুডুর দেহ, মা এবং স্ত্রী পুলিশি অত্যাচারের ভয়ে লালমোহনের দেহ নেন না, লালমোহনও পুড়ে যান, বেওয়ারিশ, কোনও মানবাধিকার সংগঠন তাঁর দেহ নিতে চাইলে প্রশাসন দেয় না, গণ্ডগোলের আশঙ্কায়।
আসলে কি শুধুই প্রেমের প্রশ্ন? হয়তো আমি রাজনৈতিক চিন্তায় অন্য পথের যাত্রী, হয়তো আমি ধর্মভাবনায় সংখ্যালঘু, হয়তো আমি যৌনতার প্রশ্নে আর দশটা লোকের মতো নই... তা হলেই সবাই মিলে আমাকে পাথর ছুড়বে, ফাঁসিতে ঝোলাবে, খুন-ধর্ষণ করবে, আমার থেঁতলে-যাওয়া মুখের ছবি ছাপাবে, সে গদ্দাফি বা কিষেনজি যে-ই হোন, আমার মৃতদেহ বিন লাদেন হলে আমেরিকা সমুদ্রে ফেলে দেবে, আমি ‘মেরা ভারত মহান’-এর ক্রূর কোরাসে গলা না মেলানো মণিপুর মনোরমা হলে সেনাবাহিনী ধর্ষণ এবং হত্যা করবে, অথবা আমি পাশের বাড়ির স্বপ্না-সুচেতা হলে পরিবার-সমাজ তাদের সীমিত ক্ষমতায় আমার দেহটা স্রেফ বেওয়ারিশ করে দেবে। আমেরিকা-মা-বাবা-পাশের বাড়ির কাকুজেঠু যে যার ক্ষমতায় আমার প্রান্তিকতাকে, আমার সংখ্যালঘুত্বকে, আমার অন্য পথের বাঁচতে চাওয়াকে তার মতো করে প্রতিনিয়ত পিষে দিয়ে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে হুল্লোড় করবে। মেনে চলো সমাজের নিয়মশৃঙ্খল, তুমি ‘অন্য’ হলেই তোমারও এই হাল হবে। স্বপ্না-সুচেতা লিখেছিল, ‘আর যদি বেঁচে থাকি অনেক দূর চলে যাবো, অনেক দূর, আর ফিরবো না...’, কিন্তু কোথায় যেত ওরা, কত দূরে? খড়ি হাতে লক্ষ্মণেরা আজও যে গণ্ডি কেটে চলেছে, অক্লান্ত!
‘... এবং বেওয়ারিশ’ ছবিটির শুটিং করতে যখন আর এক বার ফিরে যাই, গ্রামের পুরুষদের রোষের মুখে পড়ে আমরা ফিরে আসতে বাধ্য হই। বিরক্ত ও বিদ্বেষী পুলিশ কর্তার কাছে সে সময় জানতে চাই, ‘আচ্ছা, স্বপ্না-সুচেতা যদি আপনার সন্তান হত?’ উত্তর পাই, ‘এ-সব আঁতলামো কোশ্চেন আমাকে করবেন না, I never like these questions.’
|
কৃতজ্ঞতা: স্যাফো ফর ইকোয়ালিটি,
ডাঃ অনুপ ধর,
ডাঃ উজ্জয়িনী শ্রীমানী |
|
|
|
|
|