|
|
|
|
|
|
|
মাংস |
ভির্হিলিয়ো পিনিয়েরা
কিউবা |
খুব সহজ ভাবেই ব্যাপারটা ঘটল। কারণগুলো ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, কিন্তু গোটা শহরটা মাংসের অভাবে ভুগছিল। প্রত্যেকেই আতঙ্কিত, কয়েকটা তেতো মন্তব্যও শোনা গেল; এমনকী প্রতিশোধ নেওয়ার কথাও উঠল। কিন্তু যথারীতি কয়েকটা হুমকি পেরিয়ে প্রতিবাদ আর দানা বাঁধল না, শিগগিরই শহরের বাসিন্দারা বিচিত্র শাকসব্জিই গিলতে লাগল।
শুধু মিঃ আনসালদো অন্য রকম ভাবলেন। খুব শান্ত ভাবে তিনি একটা বড় ছোরায় শান দিতে লাগলেন, আর তার পর প্যান্টটা হাঁটু অবধি নামিয়ে, নিজের বাঁ পাছা থেকে একটা সুন্দর মাংসের ‘ফিলে’ কেটে নিলেন। তার পর টুকরোটাকে পরিষ্কার করে, ভাল করে নুন ও ভিনিগার মাখিয়ে, ওটাকে ব্রয়লারের মধ্যে দিয়ে দিলেন ও সবার শেষে তাঁর বড় তাওয়াটাতে (যেটাতে তিনি প্রতি রবিবার টরটিলা বানান) সেটাকে ভাজলেন। তার পর টেবিলে বসে চমৎকার মাংসের খণ্ডটি খেতে লাগলেন। ঠিক তখনই দরজায় খটখট শব্দ শোনা গেল; আনসালদোর প্রতিবেশী তার হতাশা উগরে দিতে এসেছিল... আনসালদো বেশ আড়ম্বর করে তাকে ফিলে-টা দেখালেন। প্রতিবেশী অবাক হয়ে যেই না সেটা সম্বন্ধে জিগেস করেছে, তিনি নিজের বাঁ পাছাটা দেখিয়ে দিলেন। প্রতিবেশীটি উচ্ছ্বসিত ও অভিভূত হয়ে একটিও কথা না বলে চলে গেল এবং অল্প পরেই শহরের মেয়রকে সঙ্গে নিয়ে আবার ফিরে এল। মেয়র আনসালদোর কাছে প্রকাশ করলেন তাঁর তীব্র ইচ্ছার কথা: তিনি চান শহরের বাকি মানুষেরাও এ ভাবেই ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে, অর্থাৎ কিনা, নিজেদেরই মাংসে, নিজেরাই পুষ্টি পাক যে ভাবে আনসালদো পেয়েছেন। ব্যাপারটার শিগগিরই ফয়সালা হল, শহরের উচ্চশিক্ষিত বাসিন্দাদের আবেগময় দাবি মেনে নিয়ে আনসালদো একদিন শহরের মেন স্কোয়ারে চলে গেলেন প্রক্রিয়াটি বোঝাতে— আর এটার তিনি একটা নামও দিলেন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে— ‘এক ব্যবহারিক প্রদর্শন— সর্বসাধারণের জন্য।’
সেখানে তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, প্রতি ব্যক্তিই তার বাঁ দিকের পাছা থেকে দুটো করে মাংসখণ্ড বা ফিলে কাটতে পারে, যেমনটা কিনা তিনি দেখাচ্ছেন ঠিক মাংসের মতো রং-এর প্লাস্টারের তৈরি একটা মডেল হুক থেকে ঝুলিয়ে। তিনি দেখালেন কী ভাবে, একটা নয়, দুটো ফিলেই কাটতে হবে, কারণ, তিনি যখন নিজের পাছা থেকে দু’টো চমৎকার ফিলে পেয়েছেন, অন্য কেউই বা নিজেকে বঞ্চিত করে একটা কম খাবে কেন? এক বার যখন এ সমস্ত দিকগুলো পরিষ্কার করে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, ওখানে উপস্থিত প্রত্যেকেই তাদের বাঁ দিকের পাছা থেকে দুটো করে ফিলে চাকলা করে কাটতে শুরু করল। এটা একটা অপূর্ব মহিমময় দৃশ্য ছিল, কিন্তু তার বিশদ বিবরণ না দিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বারে হিসেব কষা হতে লাগল, কত দিন ধরে শহরের মানুষেরা তাদের নিজেদের মাংসের সুবিধে উপভোগ করতে পারবে। এক জন স্বনামধন্য চিকিৎসক অনুমান করে বললেন যে, কোনও ব্যক্তির ওজন যদি একশো পাউন্ড হয় (নাড়িভুঁড়ি ও অন্য খাওয়ার অযোগ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে হিসেবের মধ্যে না রেখে), তা হলে সে একশো চল্লিশ দিন ধরে প্রতি দিন আধ পাউন্ড করে মাংস খেতে পারবে। হিসেবটা ছিল অবশ্যই বিভ্রান্তিকর। তবে আসল গুরুত্বপূর্ণ যা: প্রত্যেকেই নিজেদের সুন্দর ফিলেগুলো খেতে লাগল। শিগগিরই মহিলাদের মুখে মিঃ আনসালদোর পরিকল্পনার নানাবিধ সুবিধের কথা শোনা গেল, কারণ যাঁরা নিজেদের স্তন খেয়ে ফেলেছেন, তাঁদের আর ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢাকাঢুকির জন্য কোনও কাপড়ের প্রয়োজনই থাকল না। নাভির ওপর অবধি একটা ঘাগরা গোছের বস্ত্রখণ্ড পরে তাঁরা দিব্যি বেড়াতে লাগলেন। কিছু মহিলা— যদিও সব্বাই নয়— আদৌ কথাই আর বলতেন না, কারণ তাঁরা নিজেদের জিভগুলোকে খেয়ে নিয়েছিলেন (যেগুলো নাকি শোনা যায় সম্রাট-বাদশাদেরও খুব পছন্দসই মাংস)। |
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
রাস্তায় মাঝে মাঝে সবচেয়ে মজাদার দৃশ্যগুলো দেখা যেত: দু’জন মহিলা, যাঁদের মধ্যে অনেক দিন পর দেখা হয়েছে, তাঁরা পরস্পরকে সৌজন্যমূলক চুম্বনটুকু অবধি করতে পারছেন না, কারণ তাঁরা দু’জনেই নিজেদের ঠোঁট ভেজেভুজে সুস্বাদু ফ্রিটার্স জাতীয় কিছু বানিয়ে খেয়ে ফেলেছেন! জেলের ওয়ার্ডেন এক জন অপরাধীর মৃত্যু-পরোয়ানাতে সই করতে পারলেন না, কারণ তিনি তাঁর আঙুলের মাংসল ডগাগুলোকে খেয়ে নিয়েছিলেন, যে ঘটনা, সর্বসেরা ভোজনবিলাসীদের মতানুযায়ী (যাঁদের মধ্যে ওয়ার্ডেনও অন্যতম), শেষমেশ সৃষ্টি করেছিল সেই সুপ্রসিদ্ধ লব্জ: খাবারটা ‘আঙুল চাটার মতো সুস্বাদু’।
অবশ্য ছোটখাটো কিছু বাধা আসছিল। মহিলাদের পোশাক প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর কর্মচারী ইউনিয়ন একেবারে প্রচলিত নিয়ম-টিয়ম মেনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদ জানাল, যারা আবার এই বলে ওই প্রতিবাদের উত্তর দিল: এমন কোনও স্লোগান এখন আর তৈরি করা সম্ভব নয়, যেটা মহিলাদের আবার উৎসাহী করে তুলবে তাদের দর্জিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে। কিন্তু এই প্রতিবাদ কখনওই খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না, এবং কোনও ভাবেই শহরের লোকেদের তাদের নিজেদের মাংস খাওয়ার ব্যাপারটাতে সত্যিকারের বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি।
এই আনন্দময় অধ্যায়ের সবচেয়ে বর্ণময় ঘটনাগুলোর একটা হল: শহরের ব্যালে-নর্তকের শেষ গ্রাস মাংস খাওয়া। তার শিল্পকলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সে তার সুন্দর পায়ের-আঙুলগুলো একদম শেষ কালে খাওয়ার জন্য বাঁচিয়ে রেখেছিল। প্রতিবেশীরা লক্ষ করছিল, সে দিনের পর দিন বড্ডই অস্থির হয়ে পড়ছে। শুধু একটা বুড়ো আঙুলের মাংসল ডগাটুকু তখন বাকি। এই সময়ে সে তার বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করল ঘটনাটিতে উপস্থিত থাকার জন্য। এক রক্তাক্ত নীরবতার মধ্যে, সে ওই অবশিষ্টাংশটুকু কেটে ফেলল এবং সেটাকে গরমটুকু পর্যন্ত না করে তার সেই গহ্বরে চালান করে দিল, যেখানে এক সময় তার সুন্দর মুখটা ছিল। ওখানে উপস্থিত প্রত্যেকেই হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেল।
কিন্তু জীবন চলতেই থাকল, আর সেটাই তো ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আর যদি হঠাৎ...? এই কারণেই কি ওই নর্তকের জুতোগুলো দেখতে পাওয়া যেত ‘অতি বিশিষ্ট স্মরণীয় বস্তুর জাদুঘর’-এর একটা ঘরে? এটা শুধু নিশ্চিত যে, শহরের সব থেকে মোটা লোকেদের মধ্যে এক জন (যার ওজন চারশো পাউন্ডেরও বেশি), তার ব্যবহারোপযোগী মাংসের গোটা ভাণ্ডারটাই মাত্র পনেরো দিনের সংক্ষিপ্ত সময়ে খেয়ে শেষ করে দিল (সে নোনতা জলখাবার আর মিঠাইয়ের খুবই ভক্ত ছিল এবং তা ছাড়া তার শরীরটা ঠিকঠাক চলার জন্যও তো বিশাল পরিমাণ খাবারের দরকার হত)। কিছু দিন পর কেউ আর তাকে খুঁজেই পেল না। স্পষ্টতই সে লুকিয়ে ছিল কোথাও... কিন্তু সে-ই যে একমাত্র লুকিয়ে গেল তা নয়, সত্যি বলতে কী অনেকেই একই রকম কাণ্ড করতে শুরু করল।
আর তাই, এক সকালে মিসেস ওরফিলা তাঁর ছেলেকে, একটা জিনিস সে কোথায় রেখেছে বারবার জিজ্ঞেস করেও কিছুতেই সাড়া পেলেন না, (সে তখন গপগপ করে তার বাঁ কানের লতি খাওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিল)। অনেক কাকুতি-মিনতি করা হল, অনেক ভয় দেখানো হল, কিন্তু কিছুতেই কোনও কাজ হল না। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ দেওয়ার ব্যাপারে যিনি বিশেষজ্ঞ, তাঁকে ডাকা হল, কিন্তু তিনি ঘটনাস্থলে মানে, মিসেস ওরফিলা দিব্যি কেটে বলছিলেন একটু আগেই ওই জিজ্ঞেস করার সময় তাঁর আদরের ছেলেটা ঠিক যেখানটায় বসেছিল পায়খানার একটা ছোট স্তূপ ছাড়া আর কিছুই উদ্ধার করতে পারলেন না।
কিন্তু এই সব ছোটখাটো বাধা আর অস্বস্তিগুলো শহরের বাসিন্দাদের সুখের সময়টাকে এতটুকুও নষ্ট করতে পারল না। কারণ, যে শহর তার উদরপূর্তির ব্যাপারে নিশ্চিত, সে কী করে অভিযোগ করতে পারে? বরং মাংসের অভাবজনিত যে বিশৃঙ্খলা আগে ছিল, এখন কি সেটার নিশ্চিত একটা সমাধান হয়নি? জনসংখ্যা যে আস্তে আস্তে বিচ্ছিরি রকমে কমে আসছিল, অন্তত লোকজনকে আর চোখে দেখা যাচ্ছিল না, সেটা মূল বিষয়টায় পর একটা নিতান্ত ‘পুনশ্চ’র মতো, এবং লোকেদের নিজেদের উদরপূর্তির দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ওপর তার কোনও প্রভাবই ছিল না। সেই ‘পুনশ্চ’টা কি আসলে ছিল সেই দাম, যা মাংস আদায় করে নিচ্ছিল তার ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে? কিন্তু এ রকম কোনও অসময়োচিত হাবিজাবি প্রশ্ন তোলা একেবারেই অবান্তর, যখন কিনা এই চিন্তাশীল গোষ্ঠী সম্পূর্ণ ভাবে পেট ভরে খেতে পাচ্ছে।
|
অনুবাদ: শৈবাল কুমার নন্দ |
|
|
|
|
|