জাতের নামে বজ্জাতি কেড়ে নিচ্ছে গরিব মা-শিশুদের মুখের গ্রাস।
সন্ধ্যারানি রুইদাস জাতে ‘বাউরি’। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর ২ ব্লক প্রশাসন তাঁকে পাবড়া গ্রামের মল্লিকপাড়ায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে কাজ দিয়েছিল। কিন্তু মল্লিকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের ‘উঁচু জাত’, কোনও বাউরির হাতের রান্না তাঁরা খাবেন না।
ফল? গত দু’বছর ধরে ওই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে হাঁড়ি চাপেনি। মরিয়া প্রশাসন শনিবার সন্ধ্যারানিকে দিয়ে ফের রান্না করায়। বিডিও নিজে গিয়ে খেয়ে আসেন। কিন্তু মল্লিকদের কেউ খাবার মুখে তোলেননি।
বছর আটেক আগে বাঁকুড়ার বীরভানপুরে প্রাথমিক স্কুলে মিড-ডে মিলের খাবার নিয়ে জাতপাত চলতে থাকায় নিজে গিয়ে এক সঙ্গে সকলকে নিয়ে খেয়েছিলেন সিপিএমের শীর্ষ নেতা বিমান বসু। পাবড়ায় মোটে একটিই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। গ্রামে প্রান্তিক চাষির সংখ্যাই বেশি। কিন্তু রাজ্যস্তরের নেতা দূরস্থান, কোনও দলের জেলা স্তরের নেতাও এখানকার সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাননি। স্থানীয় কিছু নেতা এবং ব্লক প্রশাসন অবশ্য কিছুটা চেষ্টা চালিয়ে এসেছে। এ দিনের রান্নার আয়োজনও তাঁদেরই করা।
হাঁড়ি-ডেকচিতে দু’বছরের জমা ধুলো সাফ করে সাতসকালেই খিচুড়ি চাপিয়েছিলেন সন্ধ্যারানি। তাঁর কথায়, “আমি নিচু জাতের বলে উঁচু জাতের প্রসূতি ও শিশুরা আমার রান্না খেত না। দিনের পর দিন রেঁধেও খাবার ফেলে দিতে হয়েছে।” এ দিন অবশ্য তাঁর উৎসাহ ছিল দেখার মতো। |
ঘরের বাইরে ‘অস্পৃশ্যতা-বিরোধী সচেতনতা শিবির’ লেখা ফেস্টুন টাঙিয়ে মাইক ফুঁকে গ্রামবাসীকে ডাকছিলেন বিডিও উৎপল ঘোষ। ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক পলাশ মল্লিকও ছিলেন। শামিয়ানার নীচে জড়ো হয়েছিলেন স্থানীয় পাড়া কেন্দ্রের কংগ্রেস বিধায়ক উমাপদ বাউরি, সিপিএমের পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি মনীষা ঘোষ ও নীলডি পঞ্চায়েতের প্রধান ঠাকুরদাস রজক, ব্লক যুব তৃণমূল সভাপতি স্বপন মেহেতারাও।
কৌতূহলে এসে জড়ো হয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু দুপুরে খাবারের পাতা পড়তেই গুটিগুটি পায়ে সরে পড়েন। শিশু, প্রসূতি ও গর্ভবতী মিলিয়ে যে ৪৫ জন ওই কেন্দ্রের আওতায়, তার মধ্যে কেবল বাউরি সম্প্রদায়ের জনা বারো খিচুড়ি খান। আর খেয়েছেন নেতা-কর্তারা। মল্লিক সম্প্রদায়ের মোড়ল ছোটুলাল মল্লিক সাফ জানিয়ে দেন, “জাতপাত নিয়ে ভাল ভাল কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু আমরা কোনও মতেই নিচু জাতের রান্না খাব না।” দিনের শেষে হতাশ সন্ধ্যাদেবীর প্রশ্ন, “প্রশাসন থেকে সবাইকে বুঝিয়ে খাওয়াবে বলেছিল। তা আর হল কই?”
এত দিনই বা হয়নি কেন? পঞ্চায়েত প্রধান ঠাকুরদাস বলেন, “আমরা বহু বার মল্লিকদের বুঝিয়েছি, হোটেলে বা চায়ের দোকানে জাত দেখে কেউ খাবার খায় না। তা হলে এখানেই বা জাতের বিচার করা হচ্ছে কেন? লাভ হয়নি।” বিধায়কের দাবি, “এখানে মঞ্চ গড়ে দিনভর বোঝানোর চেষ্টা করেছি। ওঁরা শুনতে নারাজ।” সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের জেলা আধিকারিক স্বপন মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “জেলায় ৪৭৯৫টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র চলছে। পাবড়া ছাড়া কোথাও এ রকম জাতপাতের সমস্যার কথা আমাদের জানা নেই।” ব্লক মেডিক্যাল অফিসার পলাশবাবুর আক্ষেপ, “অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের চাল-ডাল-সব্জির খিচুড়ি খুবই পুষ্টিকর। এই সব করে আখেরে শিশু, প্রসূতি ও গর্ভবতীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।” তাঁদের মতে, কুসংস্কারের কারণে কিছু লোক যেমন বাড়ির শিশুদের পোলিও টিকা খাওয়াতে চান না, এ-ও অনেকটা তেমনই। প্রশাসন অবশ্য হাল ছাড়তে নারাজ। বিডিও বলেন, “সোমবার থেকে ওই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে ফের রান্না হবে। সন্ধ্যাদেবীই রান্না করবেন।” |