সরকার শিল্পের জন্য জমি না নিলে রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট দালাল-রাজ দাপিয়ে বেড়াবে বলে যে শঙ্কা বরাবরই করে এসেছে শিল্প মহল, লোবা সেই শঙ্কাকেই সত্যি প্রমাণ করেছে। এক দিকে নদীর পেটে-যাওয়া জমি কিনে বসে শিল্প সংস্থা। অন্য দিকে ঘোষিত দামের চাইতে অনেক কমে জমি বেচে মাথা চাপড়াচ্ছেন বেশ কিছু গ্রামবাসী।
মুখ্যমন্ত্রী বরাবরই শিল্পপতিদের কাছে আবেদন করে এসেছেন, জমির মালিকদের থেকে সরাসরি জমি কিনতে। অথচ জমি কেনাবেচায় ডিভিসি-এমটা (লোবা অঞ্চলে যে সংস্থার খোলামুখ কয়লাখনি গড়ার কথা) স্থানীয় দালালদের রীতিমতো সাহায্য নিয়েছে, সে কথা স্পষ্টই জানালেন গ্রামবাসীরা। কৃষি জমিরক্ষা কমিটির নেতারাও অভিযোগ করলেন, একাধিক বার জেলা ও রাজ্য প্রশাসনকে এমনকী, শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কেও চিঠি দিয়ে দালাল-রাজ বন্ধ করার আবেদন করা হয়েছে। একই দাবি করে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখেছেন লোবার আন্দোলনে দীর্ঘদিন জড়িয়ে থাকা পিডিএসের রাজ্য সম্পাদক সমীর পুততুণ্ড। কিছুতেই কিছু হয়নি। দুবরাজপুর রেজিস্ট্রি অফিসে এমটার তরফে খাগড়া-জয়দেব কোল মাইনস প্রজেক্টের নামে অধিকাংশ জমি হস্তান্তর হয়েছে।
কী ভাবে কাজ করেছে এই দালাল চক্র? এলাকা ঘুরে জানা গেল, কোনও কোনও ক্ষেত্রে জমির মালিক দালাল মারফত শিল্প সংস্থার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দালালরা জমির মালিকের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অসুবিধার সুযোগ নিয়ে সরাসরি জমি কিনেছেন। এমন অনেক জমির মালিকও ছিলেন, যাঁরা খনি-প্রকল্প সম্পর্কে ভাল করে জানতেনই না। একর প্রতি কত দাম মিলবে (তখন বলা হয়েছিল দো-ফসলির জন্য ১০ লক্ষ, বাস্তুজমির জন্য ৮ লক্ষ এবং বালিজমির ক্ষেত্রে ৪ লক্ষ টাকা প্রতি একর), তা-ও তাঁরা আদৌ জানতেন না। তাঁদের অজ্ঞতার সুযোগে দুই বা তিন লক্ষ টাকা একর প্রতি দামে কিনে, সেই জমিই দালালরা শিল্পসংস্থাকে বেচেছেন অন্তত তিনগুণ দামে। অন্য দিকে, অজয় নদের গর্ভে চলে গিয়েছে, অথচ ভূমি দফতরে এখনও রেকর্ড আছে, এমন জমিও বিক্রি করে দিয়েছে দালালেরা, অভিযোগ করলেন কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সম্পাদক জয়দীপ মজুমদার। |
২০০৮ সাল থেকেই বিক্ষিপ্ত ভাবে খাগড়া-জয়দেব কোল মাইনস প্রজেক্টের (কয়লাখনি প্রকল্পের পোশাকি নাম) জন্য দালাল মারফত জমি কেনা শুরু হয়েছিল লোবা অঞ্চলে। ২০১০-১১ সালে জমি কেনা আরও জোর পায়। ইতিমধ্যেই প্রায় ৭৬০ একর জমি কিনে ফেলেছে ওই সংস্থা। শুধু পলাশডাঙা মৌজাতেই ৪০০ একরেরও বেশি জমি কেনা হয়েছে। গ্রামবাসীর বক্তব্য, প্রায় পুরোটাই দালাল মারফত। এই দালালদের অনেকেই স্থানীয় বাসিন্দা। তাঁরা নিজেরা যেমন পারিবারিক জমি বেচে দিয়েছেন, তেমনই এলাকার মানুষকে প্রভাবিত করে জমি বেচতে রাজি করিয়েছেন। এই কারবার করে দালালদের অনেকেই বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছেন।
পলাশডাঙায় আদি বাড়ি, অধুনা দুবরাজপুর পুর-শহরের বাসিন্দা তেমনই এক জমির কারবারি ফুঁসে উঠে বললেন, “দোষটা কী করেছি? আমাদের পরিবারের জমি ছিল। সেটাই বেচেছি। আর জ্ঞাতি ও প্রতিবেশীদেরও বুঝিয়েছি শিল্পের জন্য জমি দিলে আখেরে তাঁদেরই লাভ!” এলাকাবাসীরও বক্তব্য, “ওই সংস্থার প্রতিনিধিরা সরাসরি গ্রামবাসীদের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় বসেননি। তা হলে দালাল ছাড়া ৭৬০ একর জমি কেনা কী করে সম্ভব? তবে কি ধরে নেব, জমির মালিকেরা লাইন দিয়ে স্বেচ্ছায় জমি বেচেছেন?”
খাগড়া-জয়দেব প্রকল্পের এক কর্তা অবশ্য বলেন, “জোর করে কারও জমি আমরা নেব না।” দালাল মারফত জমি কেনার অভিযোগও ডিভিসি-এমটা কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই অস্বীকার করেছেন। কিন্তু ঘটনা এই যে, উপরোক্ত জমির কারবারিকেই ডিভিসি-এমটা কার্যত লোবার কয়লা প্রকল্পে নিজেদের কর্মীর মর্যাদা দিয়েছিল। বীরভূম জেলা প্রশাসনের মধ্যস্থতায় কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সঙ্গে এক বৈঠকে (২০১১ সালের ২২ ডিসেম্বর) উপস্থিত থাকা ওই লোকটিকে ডিভিসি-এমটা তাদের ‘প্রতিনিধি’ হিসাবেই উল্লেখ করেছিল।
দালালরাও অবশ্য পাল্টা অভিযোগ করলেন। “খোঁজ নিয়ে দেখুন, লোবা সংলগ্ন বাবুপুর গ্রামে পারিবারিক জমি (দাগ নম্বর ১৬৮৯) এমটাকে বেচেছেন কমিটির এক শীর্ষ নেতা ও তাঁর আত্মীয়েরা,” বললেন তাঁদেরই এক জন। দুবরাজপুর রেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে কমিটির আরও দুই নেতার নাম পাওয়া যাচ্ছে, যাঁদের বাবা-মা দালাল মারফত জমি দিয়েছেন। জমির মালিকেরা রাজনৈতিক মদতে পুষ্ট দালালদের শাসানিতে জমি বেচতে বাধ্য হচ্ছেন, এই নালিশও শোনা গেল বারবার। লোবা সংলগ্ন বড়াড়ি, জোপলাই, পলাশডাঙা গ্রামের একাধিক বাসিন্দার কথায়, “একটা সময়ে সিপিএম এই দালালদের সমর্থন জুগিয়েছে। ধীরে ধীরে তৃণমূল সেই জায়গা নিয়ে নিল। নগদ টাকার হাতছানিতে এলাকার কিছু তৃণমূল নেতা-কর্মী জমি বেচার লোভনীয় কারবারে নেমে পড়ল।”
জমির দালালিতে জড়িয়ে পড়ার জন্যই সূচনা থেকে কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সদস্য এলাকার এক দাপুটে তৃণমূল নেতা পরে কমিটি ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির এক সদস্য, যিনি কৃষিজমি কমিটির ব্যানারে ভোটে জিতে পরে তৃণমূলে যোগ দেন, তাঁরও নাম এই জমির কারবারে জড়িয়েছে। যাঁরা এক সময় জমি বেচতে রাজি হয়েও পিছিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের অনেককেই “পরে আর জমি বেচতে দেব না” এই শাসানিও দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের তির বর্তমান শাসকদলের দিকেই। শিল্পের জন্য জমি কেনার বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নীতি বাস্তবে কতটা কার্যকরী, প্রশ্ন তুলে দিল লোবা। |