|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
আঁতলা ভিড় পাতলা হ |
সৌমিত্রর রাগ: বচ্চন কেন ফিল্মোৎসব উদ্বোধনে? বাঃ, সত্যজিতের
আঁতেল ছবির চেয়ে তো বচ্চন-ফিল্ম অনেক বেশি হিট!
চন্দ্রিল ভট্টাচার্য |
সারা পৃথিবী হিংসেয় ভাজা-ভাজা, এক স্টেজে শ’নক্ষত্রের জেল্লায় ক্যামেরা নালেঝোলে, বাংলা জগৎসভাকে আড়াই প্যাঁচে আছড়াচ্ছে নেতাজি ইনডোরে, এর মধ্যে আবার কে পুচুক চুকলি কেটে বেরিয়ে গেল! সৌমিত্রবাবু মুখ-ফস্কা কমেন্ট ছেড়ে ভাবছেন, ছক্কা! আচ্ছা, ফিলিম নিয়ে বলার উনি কে? হ্যাঁ, তিন ভুবনের পারে-তে টুইস্ট নেচেছিলেন চলেব্ল, ঝিন্দের বন্দী-তে গুরুর সঙ্গে রসমুন্ডি সাইজের টক্কর, কিন্তু ওঁয়ার ক্লেম টু ফেম তো সত্যজিৎ রায়ের চোদ্দোটা আঁতলা ছবি। মাইন্ড করবেন না, সত্যজিৎকে হেব্বি রেসপেক্ট করি, স্ট্যাচুর কাছে কাগ বসলে ডবল-হুশ, কিন্তু বস, ছবিগুলো তো টোটাল বোর, আগাপাছা বোঝা শক্ত। বচ্চনের ফিলিমের ধারেকাছে সে সব আঁতলামো পৌঁছয়? বচ্চন এক বার এসে দাঁড়াবে, লাল্লাল তাকাবে, বজ্র-ডায়লগ ঝাড়বে: হিটের বড়মামা! আর্টের ঢপের চপ অনেক শুনেছি, ফিলিম মানে আল্টিমেটলি তো বিনোদন। আল্টিমেটলি কেন, প্রথমতও বিনোদন। দ্বিতীয়তও। চৌত্রিশতও। আমি টিকিট কেটেছি, তুমি পুষিয়ে দেবে। লাচা হবে, গানা হবে, ঢিচক্যাঁও হবে, দশকর্মভাণ্ডারে যা যা আইটেম ভরপেট্টা, শেষে আমি হিসি-ফিসি সেরে দাঁত বের করে পৃথিবীতে এগ্জিট, হাওয়ায় জর্দার মতো আনন্দ ফুরফুর। সেইটাই তো সিনেমা। সিনেমা তো চার পাশে ডেলি যে ক্যাচড়া দেখছি সেটাকেই আর এক বার পর্দায় ছলকাবার মাজাকি নয়। তা হলে আদৌ হল-এ ঢুকব কেন? ঘাম-চিটচিট এসপ্ল্যানেডে গিয়ে অ্যাত্তবড় হাঁ করে দাঁড় খেলেই হয়! আসলে গোটা বাংলাটা পাকা-দাড়ি চুলকোনো আঁতেলে ভরে গেছে। আর্ট মানেই বোঝে অন্ধকারের মধ্যে একটা গরিব বুড়ো হাঁপ টেনে মরছে। শিল্প কাকে বলে, সিনেমা কাকে বলে, এগুলো অ্যাদ্দিন ঠিক করে দিত এই হেঁপো ডেঁপোগুলোই, এদের উদ্ভুট্টে মন্ত্র: যা কিছু পয়সা তোলে, পপুলার, ব্যাপক ফুত্তি দেয়, সেগুলো সব খারাপ, আর যে আবছা পেছনপাকা ট্যান-গুটুলি তিনটে সিড়িঙ্গে গাঁজাখোর ছাড়া কেউ বুঝতে পারেনি, সেগুলো হুর্রেপাখি। আমরা এসে ও সব নেকুফোঁড়া শন্না দিয়ে গেলে, ফচাং! সিনেমা কাকে বলে ঠিক করবে কে? মানুষ। যুগে যুগে শিল্প ভাল না মন্দ ঠিক করেছে কে? পাবলিক। যে পাবলিক আহিরভৈরোঁ বাপের জম্মে না শুনে ‘কোলাভেরি ডি’ হেদিয়ে শুনেছে, যে মানুষ ‘কোমল গান্ধার’-কে এগজ্যাক্ট দু’দিনে থেঁতলে ফ্লপিয়ে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’কে তিন মাস টাকে তুলে নেচেছে, সেই জনগুষ্টিই তো শিল্পের সবচেয়ে বড় বিচারক! ফ্র্যাংকলি বলো তো ভাই, ইন্দ্রজাল কমিক্স আর কাফকা পাশাপাশি রাখলে পাবলিক কোনটা পড়বে? এ বার, কম পাবলিক কাফকা পড়ল বলে সে বেটার লেখক, এটা কোথাকার আচাভুয়া গণিত? সিনেমা মানুষের। সিনেমার উৎসব মানুষের। এখানে ম্যাথ্স মেনে, জয় বাবা তারকনাথ জিতবে, জয় বাবা তারক-ভস্কি নতমুখে নখ খুঁটবে। |
|
সৌমিত্রবাবুর কথায় ইঙ্গিত: ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল একটা গ্রাম্ভারি সিরিয়াস ঘ্যাম, এডিনবরা থেকে পাশ দিয়ে আসতে হয়। যেন ফেস্টিভ্যালে দেখাতে হবে অ্যায়সান সিনেমা, যেখানে সিনে-ভাষার মারকাটারি নিরীক্ষা, আর ছবির বিষয়ে প্রথাগত ভাবনার উল্টোবাগে তাকধাঁধানো ডিগবাজি। যেন ফেস্টিভ্যালের দায়িত্ব মেনস্ট্রিম ছেড়ে অন্য ধারার ফিল্মের প্রতি পছন্দ গড়ে তোলা। কেন ভাই? লোকের পছন্দ ক্যাবারে, তাদের নাক টিপে বিষতেতো ‘বাবারে’ গেলাবার ইজারা তোমায় কে দিল? আর, ফিল্মের আবার সিরিয়াস! ফেস্টিভ্যালে নাম করতে হলে চাড্ডি স্বাস্থ্যবতীকে বেমক্কা ন্যাংটো দেখাতে হয়, মাঝে মাঝে ক্যামেরাটা খামখা বেঁকিয়েচুরিয়ে লেন্সে গঁদ ঢেলে আউট অব ফোকাস। হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনেছি, ফিলিম পড়ার হেবি ফ্যাশন দেশেবিদেশে, হরদম সেমিনার, কোন সিনেমায় কবি কী বলিতে চাহিলেন বাঁশ-প্রবন্ধ ফেনিয়ে ফ্ল্যাটের ইএমআই অবধি শোধ। কিন্তু ভায়া, ‘অ্যাদ্দিন হয়ে এসেছে’ বা ‘সব জায়গায় হয়’-কে আমরা ‘এখানেও এমনটাই হবে’-তে ট্রানস্লেট করি না। আমরা অরিজিনাল বিপ্লব গড়ি। অন্যের ঝাল খাই না। যদি সারা পৃথিবীর সব ফেস্টিভ্যাল গোমড়া কাটিং সিনেমার পিংখাড়ুদর্শন তারকারাই উদ্বোধন করে থাকেন, ডোন্ট কেয়ার। শারুখ বচ্চন মিঠুন কোটি কোটি মানুষকে যুগ যুগ আনন্দে চুবিয়েছেন। আজ সারা পৃথিবী ভারতকে চেনে বলিউডের দেশ বলে। বচ্চনের দেশ বলে। শারুখের দেশ বলে। তাই সিরিয়াসপনার হাড় জ্বালিয়ে মাস্-আনন্দদাতারাই আমাদের মূল গেস্ট হবেন। ছল্লিবল্লি পারে না কিন্তু কাসারাভল্লি, মেন জলের ফিশ নন কিন্তু গোপালকৃষ্ণন এ সব মাল নয়। নিজের বউ ছাড়া কেউ এদের নাম জানে না।
এবং বাবু, সিরিয়াস ফিল্ম ক্যাজুয়াল ফিল্ম বলে কিছু হয় না। ফিল্ম দু’ধরনের: গুড আর ব্যাড। গুড যে ফিল্ম বিক্কিরি হয়। ব্যাড যে ফিল্ম বিক্কিরি হয় না। মৃণাল সেনের ফিল্ম চলেনি। মারোঝ্ঝাড়ু! জনি লিভারের ফিল্ম চলেছে। গুরুগ্গুরু! ফিল্ম একটা প্রোডাক্ট। মাথার তেল। গোলা সাবান। মশার ধূপ। তোমার ইন্টেলেকচুয়াল মাস্টারবেশন দেখার কারও সময় নেই বাপ, ইচ্ছেও নেই। আমরা মস্তি চাই। মজা। মানুষের ঢল। জিন্দাবাদ ধ্বনি। হাউসফুল বোর্ড। যুগে যুগে ফিল্ম এ ভাবেই, এ ভেবেই, বানানো হয়েছে। তোমার ধারণা, সিরিয়াস ফিল্ম তুড়ুক লাফে আর্টের সিলিং হতে সত্যের ঝুল পাড়ার জন্যে বানানো হয়? ঘণ্টা। ওটাও বেচার জন্যে বানানো হয়। ওখানে বিষণ্ণতা বেচা হয়। বা সমাজ-উদ্ধার। বা কায়দাবাজির গিমিক। কেনে তারকাটা পাবলিক, যাদের মাথার ইস্ক্রুপ ঢিলে করে কে সেঁধিয়ে দিয়ে গেছে: নিরানন্দ সাত-প্যাঁচালো দেড় ঘণ্টাই চলচ্ছবির সেরা দান। আমাদের বাংলার এক মহান পরিচালক আঁতলা ডিরেক্টরদের ঝাপড়া মেরে বলতেন, ‘আমি প্রোডিউসারদের জাঙিয়া পরিয়ে রাখি না।’ ব্যাপক। আমরাও প্রযোজকদের বেওসা-লজিকে বিশ্বাস করি। জাঙিয়া আর টাই পরে তাঁরা কান বা বগল বা কুঁচকিতে প্রাইজ নিতে উঠুন, চাই না। তার বদলে যদি সংস্কৃতিকেই জাঙিয়া পরিয়ে রাখতে হয়, রাখব। যদি আর্টকে জাঙিয়া পরাতে হয়, পরাব। বাচ্চু, ফিল্ম একটা বিশাল ইন্ডাস্ট্রি, এটা আধুনিক পদ্যের পারভার্ট বই নয় যে টিউশনির টাকায় বের করে দেবে। লাখ লাখ টাকা লাগে, কোটি কোটি। নিজের রোজগারের মুরোদ নেই, অন্যের টাকায় আত্ম-পুড়কি ভাজবি, তার পর তা ফেরত চাইলে আর্টের আড়ালে টুকি দিয়ে ধাপ্পা? খাবি কানের গোড়ায়? স্ট্রেট ডিক্ট্যাট: ছবি এমন করো, যা লোকে খাবে। ছবির ফেস্টিভ্যাল এমন করব, যা লোকে খাবে। এই মেসেজগুলো এক দিন না এক দিন আঁতেলদের দাড়ি মচকে কাউকে না কাউকে দিতেই হত। আমরা পরিবর্তনের কাণ্ডারি, সেই অপ্রিয় কিন্তু প্রচণ্ড জরুরি কাজটা করলাম। হিস্ট্রির স্যালুট আমাদের পাওনা রইল।
হ্যাঁ, ভুল কিছু হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা এত ঠিকঠাক থিমে বাজল, ও দিকে ফেস্টিভ্যালের গুচ্ছ ফিল্ম সে-ই গাছশক্ত। ঘ্যানঘ্যানে। এ যেন, ইঞ্জিন পৌঁছে গেল তাজমহল, কামরাগুলো ভুশুন্ডির মাঠে ভ্যাবলা। কে কোচোয়ান সাত দিন ধরে মেটে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছে আর কে ভাইবোন গা-গুলোনো ইন্টুমিন্টু শুরু করে দিল, এ সব সিনেমা আনা উচিত হয়নি। সিনেমা মানুষের মন ভাল করবে। সুস্থ, পরিচ্ছন্ন সংস্কিতির দিকে নিয়ে যাবে। যেমন বচ্চন বা শারুখের সিনেমা করে। শেষ সিনে দুষ্টু লোক ঢিশুম খায়, ঠিক ঠিক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। ভাল রুচি গড়ে ওঠে। পরের বার থেকে চেষ্টা করতে হবে শুধুই বিন্দাস সিনেমা আনার। হলিউড, বলিউড। ঝিংচ্যাক এনজয়-পুরিয়া। আমাদের যেটুকু পিছটান রয়ে গেছে, ফেস্টিভ্যালের ঔচিত্য-ভণ্ডামির গুঁড়ো পড়ে আছে, কাগের গু-র মতো ঝেড়ে ফেলতে হবে। পরের বার যদি সলমন খান শার্ট খুলে নেচে (অবশ্যই রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে) উদ্বোধনটা সেরে নেতাজি ইনডোর কাঁপিয়ে দেন, বাকি ফেস্টিভ্যালটার জামা সমান হ্যাঁচকায় খোলার ব্যবস্থা না করলে, মালটা খাপে খাপ পঞ্চার বাপ হবে না। ঢলঢল করবে। তখন ঠিক ফাঁক দিয়ে আঁতেলের সৌমিত্র, বাংলার সৌ-শত্রু ঢুকে পড়বে! |
|
|
|
|
|