রক সঙ্গীতের নক্ষত্রের ঘরে যে ধন থাকে, এই বার নরেন্দ্র মোদীর ঘরে সেই ধন থাকিবে। নির্বাচনী প্রচারে উনি কাজে লাগাইবেন থ্রি-ডি হলোগ্রাফিক প্রক্ষেপণ প্রযুক্তি, যাহার ফলে একটি মানুষের ত্রিমাত্রিক ছবি বহু লোকে দেখিতে পায়। ম্যাডোনার জলসায় ইহা দর্শককুলকে সম্মোহিত করিয়া থাকে, ভোটভিক্ষায় তাহার অভিষেক এই প্রথম। বিশেষ ভাবে প্রস্তুত মঞ্চে উঠিয়া মোদী যখন বক্তৃতা দিবেন, তখন একযোগে চারটি শহরে হয়তো সেই বক্তৃতা লোকে এমন ভাবে দেখিতে ও শুনিতে পাইবে, যেন কোনও আশ্চর্য উপায়ে সত্যই মোদী একই সঙ্গে চারটি স্থানে উপস্থিত হইয়া বক্তৃতা দিতেছেন। মোদীর প্রয়াস, ক্রমে চার হইতে যথাসম্ভব অধিক সংখ্যায় ইহাকে লইয়া যাওয়া, যাহাতে তাঁহার ভ্রমণের ঝক্কি কমিয়া আসে ও মানুষের উন্মাদনা বাড়িয়া যায়। সত্যই, একটি মানুষের পক্ষে দিনের পর দিন সহস্র স্থানে হেলিকপ্টার করিয়া উড়িয়া যাওয়া ও একই বক্তৃতা হানিয়া বিভিন্ন জনসমষ্টিকে ক্রমাগত মুগ্ধ করার দায় কী ভয়াবহ! ক্লান্তি যেন বুঝা না যায়, বিরক্তি যেন গোপন থাকে, কণ্ঠ যেন সম-পরিমাণ জোরের সহিত ধাবিত হয়, ব্যঙ্গোক্তিটির সময় যথাযথ অঙ্গভঙ্গি যেন এতটুকু না টাল খায়, দক্ষ অভিনেতার মতো সকল বিষয়ে তীব্র নজর জারি রাখিয়া তবে নিজ আদর্শের প্রকৃত বিজ্ঞাপন, বা মৃদু করিয়া বলিলে, নিপুণ উপস্থাপন সম্ভব। এই শারীরিক শ্রম কোনও উপায়ে হ্রাস করা যায় যদি, একটি বক্তৃতা দিয়া একটি মুহূর্তে দেশের সকল কোণে পৌঁছাইয়া যাওয়া চলে, বক্তৃতাটিও অনেক বেশি প্রাণশক্তি ও স্ফূর্তিসম্পন্ন হয়, কায়িক সমস্যা দূর হইয়া কেবল নান্দনিক ও বিষয়গত দিকে অধিক মনোযোগ প্রদান করা চলে।
মোদী চিরকালই তাঁহার নির্বাচনী অভিযানে অভিনবত্বের পক্ষপাতী, তাঁহার নিজের অসংখ্য মুখোশ প্রস্তুত করিয়া চতুর্দিকে ছড়াইয়া দেওয়াও এক সার্থক আয়ুধ হিসাবে বিবেচিত হইয়াছিল। কিন্তু এই নূতন অস্ত্রটির তাৎপর্য অতলান্ত। এখানে বক্তৃতারত নেতাটির শুধু ক্যালরি বাঁচানো হইতেছে না, তাঁহাকে এক ধাক্কায় ঈশ্বরের পর্যায়ে উন্নীত করা হইতেছে। বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের যত মুগ্ধতাই থাকুক, সে যে এক মানুষকে একাধিক স্থানে একই মুহূর্তে হাজির করিয়া দিতে পারে, তাহা অন্তত এই ঝাড়ফুঁকের দেশে অবিশ্বাস্য বলিয়াই ঠেকিবে। ফলে এক হইতে বহু হইয়া যাওয়ার এই ঘটনা প্রবল অলৌকিক কাণ্ড ব্যতীত কিছু বলিয়াই প্রতিভাত হইবে না। ঈশ্বরের সংজ্ঞানুযায়ী, তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বক্ষম ও সর্বত্র উপস্থিত। কেহ যদি নিজেকে ঈশ্বর বলিয়া জাহির করিতে চান, প্রথম দুইটি গুণ তাঁহার নিজস্ব গর্বোদ্ধত উচ্চারণের উপর নির্ভর করিতেছে, কিন্তু শেষ গুণটি তো আয়ত্ত করা অসম্ভব। পক্ষান্তরে, কেহ যদি আচম্বিতে শেষ গুণটি আয়ত্ত করিয়া দেখাইতে পারেন, চমৎকৃত ও বিহ্বল দর্শককুল আর অন্য দু’টি লইয়া প্রশ্নই তুলিবে না। তাঁহার সামান্য কার্যও তখন দিব্য আলোকে বিম্বিত হইবে। তাঁহার উপস্থিতি যে বহু স্থানে একযোগে সম্ভব, ইহাই এমন ইঙ্গিত জনমানসে সৃষ্টি করিবে: তাঁহার প্রখর অনুসন্ধানী দৃষ্টি ও চৈতন্য সর্বত্র ব্যাপ্ত। লোকে অন্তত অবচেতনে ভাবিতে শুরু করিবে, ইনি আমাদের হৃদয়মধ্যে অবস্থিত গোপন কুঠুরিটি অবধি পড়িয়া লইতেছেন। হয়তো কলঘরে তাঁহার নিন্দা করিতেছি, ধাঁ করিয়া এক ত্রিমাত্রিক প্রক্ষেপণ আসিয়া গাঁট্টা কষাইয়া দিল।
অবিশ্বাসীকেও ইহা টানিবে বিলক্ষণ। চক্ষুর সম্মুখে মোদী গলা ছাড়িয়া উদ্বোধিত করিতেছেন, অথচ উনি প্রকৃত পক্ষে এখানে আদৌ নাই, এই তথ্যটুকুই সেই বক্তৃতা শুনিতে যাইতে ও চক্ষু গোল্লা করিয়া উহার সাক্ষী থাকিতে প্রণোদিত করিবে। সংবাদ হিসাবে ইহার মূল্য তো অপরিসীম। এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাবদই যদি প্রবল উৎসাহ ও প্রচার জন্মে, অর্ধেক কেল্লা ফতে। ইহার ফলে ভোট সকল স্থল হইতে একই দলের প্রতি ধাবিত হয় কি না, সময় বলিবে। গন্তব্য গৌণ, যাত্রাপথটিকে কুর্নিশ করিতেই হয়। |