উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে না-গেলেও গত বার সমাপ্তি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। কিন্তু এ বার, অষ্টাদশ কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শনিবার নন্দনে ওই অনুষ্ঠানমঞ্চে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প বা টালিগঞ্জে অবদানের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বক্তৃতায় সত্যজিৎ-ঋত্বিক-তপন সিংহের কথা উল্লেখ করলেন, এমনকী অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত মৃণাল সেনকে ‘মৃণালদা’ বলেও সম্বোধন করলেন, স্মরণ করলেন উত্তম কুমারকেও, কিন্তু এক বারের জন্যও নিলেন না বিশিষ্ট ওই অভিনেতার নাম। তাই, মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় ও তাঁর সরকারের সঙ্গে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কের বরফ আরও জমাট বাঁধল বলে সাংস্কৃতিক মহল মনে করছে।
বিশেষ করে এই ব্যাপারে অভিনেতার বক্তব্য থেকে সে রকমই ইঙ্গিত। এ দিন সন্ধ্যায় সৌমিত্রবাবু তাঁর নাটক ফেলেছিলেন বহরমপুরে। সেখানে রাতে এই ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আমার নাম নিল বা নিল না, তার উপর আমি বেঁচে আছি কি নেই, নির্ভর করে না। আমি এমনিই বেঁচে আছি।” সমাপ্তি অনুষ্ঠানে তিনি গেলেন না কেন? এর উত্তরে প্রথমে সৌমিত্রবাবু বলেন, “এ বার চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও সমাপ্তি অনুষ্ঠানের কোনও আমন্ত্রণ আমি পাইনি।”
চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্যোক্তাদের পক্ষে হরনাথ চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, “নন্দনে উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে তো বটেই, সেই সঙ্গে এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে শনিবার সন্ধ্যার চা-চক্রেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কেন তিনি এলেন না, সেটা সৌমিত্রবাবুই বলতে পারবেন।” উদ্যোক্তারা এমন দাবি করেছেন, সে কথা সৌমিত্রবাবুকে জানানোর পর অবশ্য তাঁর বক্তব্য, “আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কি না, সেটা আমি বলতে পারব না। আমি দেখিনি।” |
গত ১১ নভেম্বর সিনে সেন্ট্রালের চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এ বারের কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে কটাক্ষ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, “চলচ্চিত্র উৎসব কোনও সার্কাস বা কার্নিভাল নয়।” পরে তিনি আরও বলেন, “একমাত্র অমিতাভ বচ্চনের বক্তৃতা ছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কোনও কিছুই এই আন্তর্জাতিক উৎসবের মর্যাদার সঙ্গে খাপ খায়নি।” সেই সঙ্গে সৌমিত্রবাবুর অভিযোগ ছিল, “শাহরুখ ও তাঁর দল চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চটা ব্যবহার করেছেন।”
শুধু বিতর্ক উস্কে দেওয়া নয়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এই মন্তব্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলকে খুশি করেনি বলে রাজনৈতিক সূত্রের খবর। এ দিন উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “হলিউড ও বলিউডের সঙ্গে তুলনা টেনে বলা যায়, এখন টলিউড-ই চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠতম জায়গা। আসলে আমাদের এখানে প্রতিভাকে ঠিক মতো যত্ন করা হয়নি। অথচ সত্যজিৎ রায় অস্কার পেয়েছেন, তিনি তো বটেই, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, মৃণালদার মতো পরিচালক টলিউডেরই। আর উত্তম কুমার তো আছেনই।” এ বারের উৎসবকে মুখ্যমন্ত্রী ‘বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্র উৎসব’ বলেও দাবি করেছেন। মমতার কথায়, “এ বার যা চলচ্চিত্র উৎসব হয়েছে, সারা পৃথিবীর মানুষ এর জন্য গর্ববোধ করবেন। কী ভাবে এই রেকর্ড ভাঙব জানি না। এ বারের উৎসব ঐতিহাসিক, স্মরণীয়, দুর্দান্ত।”
কাজেই সেই উৎসবকে ‘সার্কাস’ বলে কটাক্ষ করার কারণেই কি মুখ্যমন্ত্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম নিলেন না? উৎসবের টেকনিক্যাল কমিটির কর্তা গৌতম ঘোষের বক্তব্য, “কার নাম নেওয়া হবে কিংবা কার নাম নেওয়া হবে না, সেটা যিনি বক্তব্য পেশ করছেন, সম্পূর্ণ তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।” আর উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান রঞ্জিৎ মল্লিক বলেন, “আমি কিছুই জানি না। কিছুই বলতে পারব না।” এমনকী, সৌমিত্রবাবুকে এ দিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কি না, সেটাও তিনি জানেন না বলে দাবি করেছেন রঞ্জিৎবাবু।
গত বার তাঁকে আমন্ত্রণের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকলেও শেষমেশ মূলত রঞ্জিৎ মল্লিকের অনুরোধেই তিনি সমাপ্তি অনুষ্ঠানে যান। কিন্তু হাজির হন নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছুটা পর। এমনকী, তাঁর জন্যই অনুষ্ঠান দেরিতে শুরু হয়। কিন্তু ওই দিন তাঁর বক্তৃতায় সৌমিত্রবাবু এক বারের জন্যও মুখ্যমন্ত্রীর নাম নেননি বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ মহল বিষয়টিকে ভাল ভাবে নেয়নি।
তবে এ বছরের ২৪ জুলাই উত্তমকুমারের তিরোধান দিবসে সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্মানিত করার সময়ে দু’জনের মধ্যে সৌজন্য বিনিময় ও কিছুটা বাক্যালাপ হয়। তখন ধরে নেওয়া হয়েছিল, দু’পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের উষ্ণতার একটা বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এ বার চলচ্চিত্র উৎসবে তা ফের নষ্ট হল বলে বাংলার সাংস্কৃতিক মহল মনে করছে।
কিন্তু সৌমিত্রবাবুর মতোই বিগত বামফ্রন্ট সরকারের ‘কাছের মানুষ’ বলে পরিচিত মৃণাল সেন। মমতার বক্তৃতায় তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। মৃণালবাবুর কথায়, “সৌমিত্র বড় অভিনেতা। আমার সঙ্গে ওর মনের ও মতের মিল সব সময়েই রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী কখনও কারও নাম করেন, কখনও করেন না। এ রকম তো হামেশাই হচ্ছে।” সমাপ্তি অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখা গেল না কেন? মৃণালবাবু বলেন, “আমি তিন দিন উৎসবে গিয়েছি, ছবি দেখেছি। জানতে চেয়েছিলাম, সমাপ্তি অনুষ্ঠানে কী ছবি দেখানো হবে? আমাকে কেউ বলতে পারেননি। তাই, আমি যাইনি।” |