|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ |
‘মহানায়ক’-এর সাজঘরে |
এন টি ওয়ান স্টুডিওর সব চেয়ে বিখ্যাত মেক আপ রুম ঘুরে এসে লিখছেন কৃশানু ভট্টাচার্য |
ওই ঘরে তিনি এখন শুধুই ছবি!
তবু তাঁর ফিরে আসার প্রতীক্ষায় যেন প্রহর গুনছে মহানায়কের সেই সাধের সাজঘর।
হ্যাঁ, তাঁর প্রয়াণের ৩২ বছর পরেও।
ফেসবুকে উত্তমকুমারকে নিয়ে যাঁরা এখনও প্রসারিত চর্চায় মেতে থাকেন, তাঁদের মধ্যে ক’জন রাখেন এই তথ্য?
জানেন কি, টালিগঞ্জের নিউ থিয়েটার্স ফিল্ম স্টুডিওর দক্ষিণ কোণে দেড়শো স্কোয়্যার ফুটের ওই সাজঘরে মহানায়কের রাজ্যপাটে আঁচড় কাটতে পারেনি কোনও পরিবর্তনের হাওয়া? সেখানে এখনও তাঁর মৌনমুখর উপস্থিতি।
সম্ভ্রমের সঙ্গে দরজার বাইরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ইতিহাস। নেমপ্লেটে লেখা ‘মহানায়ক উত্তমকুমার/ পারসোন্যাল মেক আপ রুম’।
“নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওয় সেই ১৯৫৬ সাল থেকে আমৃত্যু এই সাজঘর ছিল তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত। তিনি ছাড়া অন্য কারও এই সাজঘরে মেক আপ করার অধিকার ছিল না। হ্যাঁ, আর কারও না,” পাশ থেকে জানালেন তাঁর বহু বছরের ছায়াসঙ্গী এনটিওয়ানের বর্তমান কর্ণধার রামলাল নন্দী। তাঁদের ৬৬ বছরের ঘরোয়া সংস্থা ‘ছায়াবাণী প্রোডাকসন্স’-এর ব্যানারেই তৈরি হয়েছিল ‘হারানো সুর’, ‘সপ্তপদী’-সহ কত যে-বক্সঅফিস হিট ছবি!
“জানেন, কখনও প্রণাম না-করে এই সাজঘরে পা রাখতেন না উত্তমদা”, রামলালবাবুর কণ্ঠে এখনও কত আবেগ।
“এই সাজঘর মৃত্যুর দিন যে-ভাবে ছেড়ে গিয়েছিলেন, আজও ঠিক তেমন ভাবেই সাজানো আছে”, জানালেন ছায়াবাণী প্রোডাকসন্স ও এই স্টুডিওর ডিরেক্টর সৌগত নন্দী। বাবার মতোই তিনিও মজে আছেন মহানায়কের ক্যারিশমায়। ‘কাল্ট ফিগার’।
ভারতের আর কোনও স্টুডিওয় কোনও নায়কের সাজঘর তাঁর প্রয়াণের বহু বছর পরেও এমনভাবে সংরক্ষিত আছে কি? ‘অল টাইম সুপার হিরো’ না-হলে কি এমন অসম্ভব কাণ্ড ঘটতে পারে? মন্দিরে প্রবেশের মতোই জুতো খুলে ওই ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সামনেই উঁচু টেবিলে রাখা মহানায়ক উত্তমকুমারের তিন বাই আড়াই ফুটের রঙিন ছবি স্বাগত জানাবে। |
|
স্মৃতির অ্যালবাম: এই সেই সাজঘর |
সেই কত যুগ আগে আঁকা। কিন্তু এখনও কী ঝক্ঝকে আর জীবন্ত!
উত্তম নেই। তিন সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে পরিষ্কার মেঝেতে আঁকা আলপনা এখনও কী তাজা! চোখ ফেরাতেই নজরে পড়বে ঘরের উত্তর দিকে সযত্নে শোয়ানো সেই ইজিচেয়ার। শ্যুটিং সেরে ফিরে এসে সিগারেট ধরিয়ে এই চেয়ারেই না তিনি এলিয়ে দিতেন কোমর-পিঠ? “আর চায়ের ফরমাশ করে হাঁক পাড়তেন”, রামলালবাবুর মুখে হাসি।
ইজিচেয়ারের পাশেই উঁচু এক টেবিলের উপরে সাদা ফ্রেমবন্দি প্রমাণসাইজের সেই আয়না। সামনের চেয়ারে বসে ওই আয়নায় মুখ দেখেই উত্তমকুমার মেক আপ নিয়েছেন সেই ৫৬ সাল থেকে। “যে-স্টুডিওতেই শ্যুটিং থাক না কেন, এই ঘরেই আসতেন মেক আপ নিতে”, রামলালবাবুর কণ্ঠে আত্মপ্রসাদ। ‘সপ্তপদী’ ছবিতে ওথেলোর সেই
|
মহানায়কের
ব্যবহৃত ইজিচেয়ার। |
বিখ্যাত সংলাপও কি বারবার ঝালিয়ে নিয়েছেন এই ঘরেই? কান পাতলে কি কল্পনায় শোনা যাবে তাঁর কণ্ঠ ‘ইট ইজ দ্য কজ, ইট ইজ দ্য কজ মাই সোল...পুট আউট দ্য লাইট, অ্যান্ড পুট আউট দ্য লাইট’? কে জানে?
ঘরের দক্ষিণ দিকের খোলা জানালা দিয়ে প্রথম শীতের মিষ্টি রোদ লুটিয়ে পড়েছে বহু ব্যবহৃত সাদা ধবধবে চাদরে মোড়া সেই শয্যার উপরে। টানা শ্যুটিংয়ের পরে ফিরে এসে ক্লান্ত শরীরটা কত দিন যে ওখানেই এলিয়ে দিয়েছেন একদা বাঙালির চোখের মণি সেই ম্যাটিনি আইডল।
কবেকার সে সব কথা!
উত্তমকুমারের ব্যবহৃত প্লেট-চামচ-গেলাসও যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছেন রামলালবাবুরা। “প্রতিদিন দু’বেলা এই ঘর ঝাড়ামোছা হয়। সকাল-সন্ধ্যায় তাঁকে স্মরণ করা হয় ধূপ জ্বালিয়ে”, স্মৃতিভারে আচ্ছন্ন তিনি। আর হবেই না বা কেন? “মহানায়কের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল দাদা-ভাইয়ের মতো”।
তাই চৌকির নীচে আজও সযত্নে রামলালবাবু সাজিয়ে রেখেছেন মহানায়কের সেই বিখ্যাত খড়মজোড়া। “জুতো বাইরে রেখে ঘরে ঢুকেই খড়মে পা গলিয়ে দিতেন। কারণ এই সাজঘরকে তিনি মনে করতেন তাঁর কর্মভূমি। ক্যামেরার সামনে কঠিন পরীক্ষায় দাঁড়ানোর আগে টানা ২৪ বছর এই সাজঘরেই চলত তাঁর প্রস্তুতিপর্ব, এমন সব অজানা তথ্য একের পর এক তুলে ধরলেন রামলালবাবু।
কেমন ভাবে মহানায়ক বিচরণ করতেন তাঁর কর্মভূমিতে, তাঁর প্রয়াণের পরেই পরবর্তী প্রজন্মকে তা জানানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রামলালবাবু। “একটা মূল্যবোধ কাজ করেছিল। তারই ফসল আজকের এই সংরক্ষিত সাজঘর।” “সারা দিনে কত বার যে ডাকাডাকি করতেন। আবার আয়কর সংক্রান্ত কোনও সমস্যায় পড়লেই আমার ডাক পড়ত তাঁর ঘরে ইনকাম ট্যাক্স কনস্যালট্যান্ট হিসেবে”। |
|
|
মহানায়কের ব্যবহৃত প্লেট ও খড়ম। |
|
শ্যুটিংয়ের শেষ বিকেলে মুড়ি-তেলেভাজার আসর বসাতেন এই ঘরে। আর মেজাজ ভাল থাকলে সলিল সেন, অসীম সরকার, আলো সরকারদের মতো পরিচালকদের নিয়ে বসতেন মজলিসে।
‘‘মৃত্যুর দিনে ‘ওগো বধূ সুন্দরী’র জন্য এখানেই মেক আপ নিয়ে যাত্রা করেছিলেন টেকনিশিয়ান স্টুডিওর দিকে। সেই শেষ যাওয়া”, স্মৃতিভারে আচ্ছন্ন এনটিওয়ানের মালিক। ইতিহাস জানে, সেই দিনও দাঁড়িয়েছিলেন ক্যামেরার সামনে। হয়ত আওড়েছিলেন শেষ সংলাপ, ‘আমিও দেখে নেব, আমার নাম গগন সেন।’”
মহানায়ক নেই। কিন্তু স্মৃতিভারে পড়ে আছে তাঁর সাধের সাজানো সাজঘর। |
ছবি: সুব্রত কুমার মন্ডল |
|
|
|
|
|