পনেরো দিনেই উল্টো যাত্রা! গত ১ নভেম্বর ভাড়া বাড়িয়ে মুমূর্ষু পরিবহণ শিল্পকে কিঞ্চিৎ অক্সিজেন জুগিয়েছিল রাজ্য সরকার। কিন্তু জনমোহিনী রাজনীতির টানে বৃহস্পতিবার বহু ক্ষেত্রেই সেই ভাড়া কমানোর সিদ্ধান্ত নিল মন্ত্রিগোষ্ঠী। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে। তাতে এক দিকে যেমন বিপাকে পড়লেন বাস মালিকেরা, তেমনি তৈরি হল বিস্তর জট।
এ দিন মহাকরণে পরিবহণ সংক্রান্ত মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠকের পরে পার্থবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরে সরকারের তরফে জানানো হচ্ছে, কোথাও ১ টাকার বেশি ভাড়া বাড়বে না।” তাঁর দাবি, “এটা ১ নভেম্বর থেকেই কার্যকর করেছে সরকার। এটা নতুন কিছু নয়।”
সোমবার জানবাজারে একটি পুজোর উদ্বোধনে গিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বাস ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে অভিযোগ শুনেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার তিনি পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র এবং শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নির্দেশ দেন, বাস ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অসঙ্গতি রয়েছে। এই বিভ্রান্তি অবিলম্বে দূর করতে হবে। নতুন ভাড়া কোনও অবস্থাতেই পুরনো ভাড়ার থেকে এক টাকার বেশি হবে না।
৩১ অক্টোবর নতুন ভাড়া ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দূরত্বের স্তরেরও (স্টেজ) পুনর্বিন্যাস করেছিল রাজ্য। সেই পুনর্বিন্যাসের ফলেই কোনও কোনও ক্ষেত্রে নতুন ভাড়া পুরনো ভাড়ার থেকে ৩-৪ টাকা পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছে। যেমন, আগে ৪ কিমি দূরত্ব পর্যন্ত বাস ভাড়া ছিল ৪ টাকা। নতুন স্তর বিন্যাসের জেরে তা বেড়ে হয়েছে ৭ টাকা। এতটা বৃদ্ধি কাম্য নয় বলেই সরকারি সূত্রের দাবি। এবং সেই যুক্তিতেই পার্থবাবুর এ দিনের ঘোষণাকে সমর্থন করছেন তাঁরা।
কিন্তু এর ফলে ৩১ অক্টোবরের বিজ্ঞপ্তি নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হয়ে গেল। দূরত্বের যে নয়া স্তরবিন্যাস ওই বিজ্ঞপ্তিবলে তৈরি করা হয়েছিল, তা বহাল থাকবে, না পুরনো স্তরেই ফিরে যাওয়া হবে, সে ব্যাখ্যা এ দিন পার্থবাবু দেননি। তিনি বলেন, “আগেও আমরা বলেছিলাম বাস ভাড়া এক টাকা করে বাড়বে। কোথাও কোথাও এর অপব্যাখ্যা হচ্ছে। কোনও কোনও জায়গায় ৩-৪ টাকাও বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে শুনতে পাচ্ছি। মুখ্যমন্ত্রীও বিষয়টি খোঁজ নিয়েছেন। কোনও অবস্থাতেই কোনও স্তরে ১ টাকার বেশি ভাড়া বাড়বে না। আগে যে স্তরে যে ভাড়া ছিল প্রতি ক্ষেত্রেই তার থেকে ১ টাকা করে বাড়বে।” |
আর পরিবহণমন্ত্রী বলেন, “আমার কোনও মন্তব্য নেই। যা বলার পার্থবাবুই বলেছেন।”
সরকারের এ দিনের ঘোষণায় বাস মালিকেরা যেমন বিভ্রান্ত, তেমনি ক্ষুব্ধও। তাঁদের বক্তব্য, সরকার তো নিজেই বাস ভাড়ার তালিকা তৈরি করেছে। সেই তালিকা অনুযায়ী ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এমনকী সরকারি বাসেও। তা হলে অপব্যাখ্যা বা বেশি ভাড়া নেওয়ার কথা আসছে কী করে! বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের নেতা দীপক সরকার বলেন, “সরকার ইতিমধ্যেই একটা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। সেটাকেই তাঁরা এ দিন চ্যালেঞ্জ করলেন। এটা তো ছেলেখেলা হচ্ছে। এতে সরকারই অসুবিধেয় পড়বে।” জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটসের নেতা সাধন দাস বলেন, “আমরা বিভ্রান্ত।”
সরকার যে কোনও ভুল করেনি তা বোঝানোর চেষ্টায় পার্থবাবু এ দিন বলেন, “ভাড়া ১ টাকা করে বেড়েছে এবং তা বেড়েছে ১ নভেম্বর থেকে। এ নিয়ে কোনও ধোঁয়াশা নেই। মুখ্যমন্ত্রীর যা নির্দেশ, সেটাই কার্যকর করা হচ্ছে।” যদিও একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, “বিজ্ঞপ্তিতে যদি কোনও অসঙ্গতি থেকে থাকে, তা আমরা বসে ঠিক করে নেব।”
কিন্তু প্রশ্ন হল, আজ শুক্রবার থেকে কী ভাড়া দেবেন বাস যাত্রীরা? সরকার প্রকাশিত নতুন ভাড়ার তালিকা মোতাবেক। নাকি, পুরনো ভাড়ার থেকে এক টাকা বেশি। পার্থবাবু বা মদনবাবু সেই বিভ্রান্তি কাটাননি। তবে সাধনবাবু বলেন, “এখনও পর্যন্ত সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে যে ভাড়া রয়েছে, আমরা কন্ডাকটরদের সেটাই নিতে বলেছি।” কিন্তু সরকারি ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে যাত্রীরা যদি সেই ভাড়া দিতে অস্বীকার করেন? সাধনবাবুর জবাব, “সে ক্ষেত্রে তাঁরা যা ভাড়া দেবেন তা-ই নেওয়া হবে।
আমরা কন্ডাক্টরদের বলেছি যাত্রীদের সঙ্গে কোনও রকম সংঘাতে না যেতে।”
বাস্তবে কী হবে তা নিয়ে অবশ্য চিন্তায় রয়েছেন বাস মালিকেরা। তাঁদের অনেকের আশঙ্কা, আজ থেকে ভাড়া নিয়ে কন্ডাক্টরদের সঙ্গে যাত্রীদের বচসা হতে পারে। এবং তা কোনও কোনও ক্ষেত্রে বড় আকার নেওয়াও অসম্ভব নয়। রাজ্য সরকার অবশ্য আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছে। পার্থবাবু এবং মদনবাবু দু’জনেরই দাবি, “এমন আশঙ্কা অমূলক। কারণ, ভাড়া সরকারই ঠিক করে। সেটাই হয়েছে।”
পার্থবাবুর এ দিনের ঘোষণা মানলে গত পনেরো দিন ধরে বাসে যা ভাড়া নেওয়া হচ্ছিল অনেক ক্ষেত্রেই তা কমে যাবে। সেটা কি মেনে নেবেন বাস মালিকেরা? দীপকবাবু বলেন, “ভাড়া কমে গেলে আমাদের আন্দোলনে নামতেই হবে। সেটা কবে, কী ভাবে করব, তা আলোচনা করে ঠিক করতে হবে।” সাধনবাবুও বলেছেন, “আগের বৃদ্ধিতেই আমাদের সুরাহা হচ্ছিল না। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হল বলেই প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। শনিবার আমরা বৈঠক ডেকেছি। সেখানেই বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।”
সরকারের ঘোষণাকে কটাক্ষ করেছে সিটুও। সংগঠনের নেতা সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন, “সরকার নিজেই জানে না, তারা কোন পথে চলতে চায়। নিজেরাই ঘোষণা করছে ভাড়া এক টাকা বেড়েছে। অথচ, সরকারি বিজ্ঞপ্তি বলছে, ভাড়া ৩ টাকা, ৪ টাকাও বেড়েছে। এ এক দিশাহীন সরকার।” সিটুর আন্দোলনের সিদ্ধান্ত বহাল থাকছে বলেই জানিয়ে দিয়েছেন সুভাষবাবু।
|
বাসে বিভ্রান্তি |
পার্থ উবাচ |
১ নভেম্বর: এক টাকা করে ভাড়া বাড়বে। বিজ্ঞপ্তি পেলেই বোঝা যাবে।
১৫ নভেম্বর: ভাড়া বাড়বে ১ টাকা করে। ১ নভেম্বর থেকে এই ভাড়াই নেওয়া উচিত ছিল। বিজ্ঞপ্তিতে অসঙ্গতি থাকলে ঠিক করে নেব। |
প্রশ্ন যেখানে |
• ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত ভাড়ার বিজ্ঞপ্তি কি ভুল ছিল?
• বিজ্ঞপ্তি কি মুখ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রিগোষ্ঠীর কেউ অনুমোদন করেননি?
• আরটিও কীসের ভিত্তিতে নতুন তালিকা প্রকাশ করলেন? |
তালিকায় অসঙ্গতি আছে বুঝতে কেন ১৪
দিন লাগল? |
• আজ থেকে কোন হিসেবে ভাড়া নেবেন কন্ডাক্টররা?
• যাত্রী-কন্ডাক্টর বচসা থেকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হলে দায়িত্ব কার? |
|