মাঝেমধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার পরবর্তীতে কয়েকদিন ধরে কড়া নজরদারি ও ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয় পুলিশ-প্রশাসনের তরফে। দিন কয়েক সতর্ক থাকার ফের আগের নিয়মেই ফিরে যাওয়া। নদীবেষ্টিত দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকায় নদী পারাপারের ক্ষেত্রে ভুটভুটি, স্টিমারে অতিরিক্ত যাত্রীবহনের ছবিটা এমনই। বহন ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে পারাপারের সময় বুধবরাই বাসন্তীর গদখালির বিদ্যানদীতে নৌকা উল্টে দুঘর্টনা ঘটে। যদিও কেউ হতাহত হননি। তবে এ ধরনের ঘটনা আগে ঘটলেও এবং তাতে প্রাণহানি হলেও অতিরিক্ত যাত্রী বহন বন্ধ হয়নি। বা বলা ভাল, এ ব্যাপারে প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যথর্।
জেলার ক্যানিং, ডায়মন্ড হারবার ও কাকদ্বীপ মহকুমার বেশিরভাগ এলাকাতেই যাতায়াতের ক্ষেত্রে নদীপথই মূলত উপায়। সে ক্ষেত্রে পারাপারের ক্ষেত্রে যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে অতিরিক্ত যাত্রী বহনে নজরদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূণর্। বস্তুত, বিভিন্ন ঘাটে ‘বহন ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া নিষিদ্ধ’ বোর্ড ঝুলিয়েই কতর্ব্য সেরেছে প্রশাসন। আর প্রশাসনের এই গা ছড়া মনোভাবের সুযোগে বিপজ্জনক হওয়া সত্ত্বেও ঘাটগুলিতে অবাধে ভুটভুটিতে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে পারাপার চলছে। |
স্থানীয় পঞ্চয়েত থেকে জেলা পরিষদ কারও কোনও হেলদোল নেই বলে অভিযোগ যাত্রীদের। তাঁদের আরও অভিযোগ, জেলার বিভিন্ন অংশে জলপথে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সংখ্যায় ভুটভুটি নেই। ফলে বিপজ্জনক জেনেও তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছনো বা বাড়ি ফেরার তাগিদে ওই ভাবে যাতায়াত করতে বাধ্য হন। তাঁদের দাবি, প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি পর্যাপ্ত নৌকার ব্যবস্থা করা হয় তা হলে বেশ ভাড়ার লোভে ঘাটগুলিতে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের প্রবণতা কমবে। তাঁরাও স্বস্তি পাবেন। অতিরিক্ত যাত্রী বহন নিয়ে গোসাবার বিডিও সুমন চক্রবর্তী বলেন, “অতিরিক্ত যাত্রী বহন নিয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু তা যে ঠিকভাবে মানা হচ্ছে না তা নজরে এসেছে। সমস্যাটি নিয়ে পুলিশ ও ঘাটমালিকদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।”
কাকদ্বীপ মহকুমার সাগর, নামখানা, পাথরপ্রতিমা-সহ বেশ কিছু এলাকার মানুষ যাতায়াতের জন্য নৌকার উপর নির্ভরশীল। পাথরপ্রতিমা ব্লকে রয়েছে মৃদাঙ্গভাঙা, পাখিরালা, গোবদিয়া, জগদ্দল, সপ্তমুখী, কার্জন ক্লিক-সহ বেশ কিছু ছোট-বড় নদী। এই ব্লকের ফেরিঘাটগুলিতে যাতায়াত করে প্রায় ২১টি যন্ত্রচালিত নৌকা। অন্যদিকে, মুড়িগঙ্গা, বটতলা নদীতে লট-৮, ঘোড়ামারা, শিকারপুর থেকে কাকদ্বীপ এবং সুমতিনগর থেকে নামখানা পর্যন্ত প্রায় ৮-১০টি ঘাটে সারাদিনে একবার যাতায়াত করে ভুটভুটি। রায়দিঘির মণিনদীতেও রায়দিঘি ঘাট থেকে দমকল, কুয়েমুড়ি মইপিঠ, শীতল মাইটি-সহ অন্য ফেরিঘাটগুলিতেও বেশ কিছু নৌকা যাতায়াত করে। প্রায় সব ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে পারাপার নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। এ ব্যাপারে পাথরপ্রতিমা পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত ও পরিবহণ কর্মাধ্যক্ষ রজনীকান্ত বেরা অবশ্য বলেন, “ইচ্ছে করে কেউ অতিরিক্ত যাত্রী নৌকায় তোলে না। ওই সমস্ত দ্বীপ এলাকার মানুষকে প্রয়োজনে পাথরপ্রতিমায় যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে কোনও অনুষ্ঠান বা রাজনৈতিক সমাবেশ থাকলে অতিরিক্ত যাত্রী নৌকায় তুলতে বাধ্য হয়।” একই বক্তব্য সাগরের প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএমের মিলন পড়ুয়া, মথুরাপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কংসমোহন কয়ালের।
প্রসঙ্গত, অতিরিক্ত যাত্রীবহন করতে গিয়ে ২০১০-এর ৩১ নভেম্বর মুড়িগঙ্গা নদীতে একটি ট্রলার উল্টে যায়। মারা যান অন্তত ৮৩ জন। খোঁজ মেলেনি অনেকেরই। ২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর মুড়িগঙ্গায় ট্রলার ডুবিতে মারা গিয়েছিলেন কয়েকজন। তার আগে ৩১ অগাস্ট ঝড়খালিতে মাতলা নদীতে ভুটভুটি উল্টে মারা যান চারজন। এ ছাড়া চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর সাগরের কচুবেড়িয়া থেকে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে লট-৮ ঘাটে ফেরার সময় নৌকা উল্টে যায়। নিখোঁজ হয়েছিলেন ১০ জন। যথারীতি প্রতি ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার পরে কয়েকদিন প্রশাসনের নজরদারি চললেও তা যে কাজে আসে না তা জানিয়েছেন নিত্যযাত্রীরাই।
পাথরপ্রতিমার অনন্ত জানা, সুখেন ঠিকাদার, বিপ্লব দাস মাঝিদের বক্তব্য, “একটা যন্ত্রচালিত নৌকায় অন্তত ১০০ জন উঠতে পারে। কিন্তু যাত্রীরা নৌকার ভিতরে না বসে উপরে বসায় সমস্যা হয়। এ ছাড়া যাত্রীদের হুমকির মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে মাঝেমধ্যে অতিরিক্ত যাত্রী নিতে হয়। তবে সাধ্যমত বিপদ এড়ানোর চেষ্টা করা হয়।” জেলার এক পুলিশ কর্তার কথায়, “অতিরিক্ত যাত্রীবহনের দিকে পুলিশের নজরদারি রয়েছে। কাকদ্বীপে নৌকাডুবির ঘটনার পর নদীবেষ্টিত সমস্ত এলাকার থানায় এ ব্যাপারে সতর্কতা জারি করা হয়েছে।” |