মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে বারাক হুসেন ওবামার পুনর্নির্বাচন আফগানিস্তান হইতে মার্কিন ও নেটো বহুজাতিক বাহিনীর ফিরিয়া যাওয়ার নির্ঘণ্টে কোনও রদবদল ঘটাইবে, এমন সম্ভাবনা কম। স্বভাবতই ২০১৪ সাল হইতে কাবুলের শাসকদের যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হইতে হইবে, বর্তমান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই সে কথা ভাবিয়া উদ্বিগ্ন। এক দিকে তালিবানের পুনরুত্থান, অন্য দিকে জঙ্গি তালিবান মারফত কাবুলের উপর ইসলামাবাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হওয়ার বিপন্নতায় তিনি উৎকণ্ঠিত। ভারতের সহিত আফগানিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে রণনৈতিক পর্যায়ে উন্নীত করিতে এ জন্যই কারজাই আগ্রহী। তাঁহার সাম্প্রতিক ভারত সফরের লক্ষ্যও ছিল সেটাই। প্রকাশ্যে এই সহযোগিতার উপর কারজাই বা মনমোহন সিংহ কেহই তত জোর দেন নাই। কেননা সে ক্ষেত্রে আগ বাড়াইয়া তালিবান ও পাকিস্তানের বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা থাকিবে। উভয় নেতাই অর্থনৈতিক সহযোগিতা, রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি পরিকাঠামো নির্মাণে সহযোগিতার উপর আলোকপাত করিয়াছেন।
এ ধরনের আর্থিক সহযোগিতা যে আবশ্যক, তাহাতে সন্দেহ নাই। বস্তুত, নয়াদিল্লি ইতিমধ্যেই আফগানিস্তানের পরিকাঠামো উন্নয়নে দুই শত কোটি মার্কিন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়াছে। কিন্তু আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নের কর্মকাণ্ডগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে যাহা করা দরকার, আফগান নিরাপত্তারক্ষীদের সেই আধুনিক প্রশিক্ষণ দিবার কাজও করিতে হইতেছে। ভারতীয় বিনিয়োগ এবং তাহা সুরক্ষিত রাখিতে নিযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার-প্রযুক্তিবিদ, কর্মী-শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তাও নয়াদিল্লিকেই নিশ্চিত করিতে হইতেছে। গত বছর সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী ইতিমধ্যেই কয়েকশো আফগান পুলিশ ও সেনা-অফিসার নয়াদিল্লি কর্তৃক আধুনিক যুদ্ধকলা ও অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষিত। কাবুল এবং নয়াদিল্লির শাসকরা ২০১৪ সালে নেটো-মার্কিন বাহিনীর বিদায়লগ্নের কথা ভাবিয়া শিহরিত, যখন আফগান তালিবান ও পাকিস্তানি তালিবানরা হাক্কানি গোষ্ঠী ও লস্কর-এ-তইবা’র মতো জঙ্গি দলের সহিত হাত মিলাইয়া কাবুলের দখল লইতে ঝাঁপাইয়া পড়িবে। প্রশ্ন হইল, তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব হইলে ভারতের সহিত আফগানিস্তানের এই চলতি বোঝাপড়া কোনও কাজে আসিবে কি?
আফগানিস্তানকে পুনরায় তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে যাইতে দেওয়া ভারতের পক্ষেও চরম বিপদের। জেহাদি সন্ত্রাসে ইতিমধ্যেই দীর্ণ ভারত জানে, তালিবান মুজাহিদিনের দখলে কাবুল চলিয়া যাওয়ার অর্থ কাশ্মীর সহ ভারতের সর্বত্র ইসলামি মৌলবাদের জঙ্গি বিস্ফোরণ অনিবার্য হইয়া ওঠা। পাকিস্তানও যে তাহার দুর্বল গণতন্ত্র জেহাদিদের হাতে সঁপিয়া দিয়া হাক্কানি, লস্কর ও পাক তালিবানের মৃগয়াক্ষেত্র হইয়া উঠিবে, তাহা নিশ্চিত। সময় থাকিতেই তাই নয়াদিল্লি, ইসলামাবাদ ও কাবুল সকলকেই রাজনৈতিক ইসলামের জেহাদি পুনর্জাগরণ প্রতিরোধ করিতে আগাম নিবারকমূলক ব্যবস্থা লইতে হইবে। হামিদ কারজাই বুঝিয়াছেন, একদা তালিবানের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান নিজেও আজ জেহাদি সন্ত্রাসের শিকার। সেখানকার নির্বাচিত পিপল্স পার্টির সরকার তো পদে-পদে জেহাদিদের সহিত আপসের মূল্য চুকাইয়া চলিয়াছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নেটো নিজেদের ঘাড় হইতে আফগানিস্তানকে ঝাড়িয়া ফেলিলেও দক্ষিণ এশিয়ার এই উপমহাদেশীয় অঞ্চলে রণনৈতিক সমীকরণ অপরিবর্তিত থাকিবে না। নূতন এই সমীকরণে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নয়, বোঝাপড়া ও আপসের মধ্য দিয়াই জেহাদি সন্ত্রাসের মতাদর্শ ও সংগঠনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জারি রাখিতে হইবে। আফগানিস্তানের জনসাধারণ ও সরকার ক্রমেই ভারতের মৈত্রী ও সহযোগিতার মূল্য উপলব্ধি করিতেছেন। তাঁহাদের প্রয়োজনের সময়ে নয়াদিল্লি হাত গুটাইয়া থাকিবে না, নিশ্চিত। কিন্তু একই সঙ্গে কাবুলে কর্মরত ভারতীয়, লগ্নিকৃত ভারতীয় পুঁজি এবং উপমহাদেশে ভারতীয় রণনৈতিক স্বার্থ যাহাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, সে বিষয়েও সতর্ক হওয়া জরুরি। |