ন’বছরের রফিক শেখ পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে। দাদা সফিক পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। এই কচি বয়সেই সংসারের হাল ধরতে তারা পড়াশুনার পাশাপাশি দিনে প্রায় ৫ ঘন্টা করে বাবা-মা’র সঙ্গে বিড়ি বাঁধে। জঙ্গিপুর মহকুমার ৭টি ব্লকের প্রায় ঘরে ঘরে রফিক, সফিকদের দেখা মিলবে। এ ছাড়াও অনেক শিশু রয়েছে যারা স্কুলের চৌকাঠ মাড়াতেই পারেনি। সবর্ক্ষণ বিড়িই বাঁধে। যেমন ছাবঘাটির কেতাবুল, উমরপুরের সুমতিরা দিনভর মায়ের সঙ্গে বিড়িই বাঁধে। এই শিশু শ্রমিকদের সংখ্যাটা ঠিক কত, তার সঠিক কোনও হিসেব নেই প্রশাসনের কাছে। ফলে শিশুশ্রম রোধের সমাধানের রাস্তাটাও এখনও পর্যন্ত অধরা।
বছর তিনেক আগে জঙ্গিপুর মহকুমায় বিড়ি শ্রমিকদের উপর দু’দুটি সমীক্ষা চালানো হয়। ‘ভলেন্টিয়ারি হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’-র সমীক্ষার হিসেব, “জঙ্গিপুরের ৬ লক্ষ বিড়ি শ্রমিকদের মধ্যে অন্তত ২০ শতাংশের বয়স ১০-এর নীচে।” অর্থাৎ ১ লক্ষ ২০ হাজার শিশু বিড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। সরকারি হিসেব মতো ১৪ বছরের কম বয়সীদের শিশু ধরলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যাটা আরও বাড়বে। অবশ্য শিশুশ্রম নিয়ে কর্মরত অন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দাবি, জঙ্গিপুরে ৮৮ হাজার শিশু বিড়ি শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। ‘শিশুশ্রম নিরোধক আইন ১৯৮৬’ অনুযায়ী শিশুশ্রম নিষিদ্ধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ‘ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রটেকশন অব চাইল্ড রাইটস’ শিশুশ্রম বন্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে একাধিকবার রাজ্য সরকারগুলিকে নির্দেশ দিয়েছে। নির্দেশে উল্লেখ রয়েছে, “শিশুশ্রম সস্তায় পাওয়া যায় এবং বিনা প্রতিবাদে তাদের দীর্ঘক্ষণ খাটতে বাধ্য করানো যায়।” কিন্তু নির্দেশিকা সত্ত্বেও বিড়ি শিল্পের সঙ্গে লক্ষাধিক শিশুশ্রমিককে আটকানো যাচ্ছে না কেন? সূুতির কংগ্রেস বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস নিজেও এক বিড়ি কারখানার মালিক। তিনি বলেন, “জেলা প্রশাসনের হিসেব মতো জেলায় মোট শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ২৬ হাজার। তার মধ্যে ১৩ হাজার শিশু শ্রমিক যুক্ত জঙ্গিপুরের বিড়ি শিল্পের সঙ্গে। তবুও এদের শিশুশ্রমিক বলা ঠিক হবে না। কারণ এলাকায় বিড়ি একটা কুটির শিল্প। শিশুরা বিড়ির পাতা কেটে দিয়ে, কখনও বিড়ি মুড়ে দিয়ে বাবা-মাকে সাহায্য করে সাহায্য করে। কখনও বা তারা তৈরি বিড়ি মুন্সির বাড়িতে পৌঁছে দেয়।” সিটুর জেলা সভাপতি আবুল হাসনাৎ খান বলেন, “শিশুরা বাড়িতে মা-বাবার বিড়ি বাঁধা কাজে সাহায্য করে। বেশিরভাগ শিশু স্কুলেও যায়। আবার অনেকে না গিয়ে শুধুই বিড়ি বাঁধে। এই শিশুশ্রম বাবা-মার সাহায্য ছাড়া বন্ধ করা যাবে না। আর্থিক সমস্যা সেই সহযোগিতার পথে অন্তরায়।” আইএনটিইউসি-র রাজ্য বিড়ি শ্রমিক ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক বাদশা আলি বলেন, “শিশুশ্রম বন্ধ করার আগে দরকার এলাকায় আর্থিক স্বনির্ভরতা। বিড়ির তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে শিশুরা ভুগছে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে। একচিলতে ঘরে থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে বিড়ি বাঁধা সবই হচ্ছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এটাই চিন্তার বিষয়।”
শিশুশ্রমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জেলা সভাপতি গোলাম নাসের বলেন, “শিশুদের স্কুলমুখী করতে স্কুলের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। পরিবার যেন বুঝতে পারে শিশুর ভরনপোষণের ভার সরকার নিয়েছে। তখন শিশুশ্রম স্বাভাবিক নিয়মেই বন্ধ হবে।” |