হাল্কা রসে ডোবানো দুধ সাদা রসগোল্লা। রস টিপে প্রথমে তাকে একটা পাত্রে ডোবানো হবে দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরি ঘন ক্ষীরের মধ্যে। বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে চুপসে যাওয়া রসগোল্লার ভেতরে ক্ষীর ঢুকে আবার তাকে ফুলিয়ে তুলবে। এর পর তাকে ঠান্ডা করা হবে। অন্য দিকে খোয়া ক্ষীর ঘিয়ে ভেজে গুঁড়ো সরে তার সঙ্গে কেশর মিশিয়ে সাজানো হবে ওই ক্ষীরে ডোবানো রসগোল্লা। নাম ‘কেশর ভোগ’। ভাইফোঁটা উপলক্ষে কৃষ্ণনগরের নির্মাতা তাপস দাস ওই শিল্প তৈরি করেছেন। ৬ টাকা প্রতি পিস। বিকোচ্ছে দেদার।
কিন্তু সন্দেশের মধ্যে ক্ষীর আর কাজু-কিসমিসের পুর দেওয়া ‘আবার খাবো’। বিশুদ্ধ ক্ষীরের তৈরি নবদ্বীপের রামকৃষ্ণ ঘোষের আম, লিচু, আতা ১০ ও ২০ টাকা প্রতিটি। অথবা বাণী ঘোষের ‘ক্রিম চমচম’ভাইফোঁটার আগের দিনে প্রস্তুত মিষ্টি ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কত জন ভাইয়ের পাতে এসব মহার্ঘ্য মিষ্টি পৌঁছবে, তা বলা শক্ত। সব জিনিসের দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে মিষ্টির। দু-একটি হাতে গোণা দোকান ছাড়া ২ টাকা বা ৩ টাকা দামের মিষ্টি পাওয়া যাচ্ছে না। ন্যূনতম ৪ টাকা বা ৫ টাকা। আর একটু ভদ্রস্থ ভাবে ভাইয়ের প্লেট সাজাতে গেলে ৮ থেকে ১০ টাকা দামের মিষ্টি কিনতে হচ্ছে। মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারকেরা দিশেহারা। মিষ্টি কিনবে তো?
নবদ্বীপের প্রবীণ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী রামকৃষ্ণ ঘোষ বলেন, “৫২ বছর ধরে ওই কাজ করছি। সব জিনিসের দাম এক সঙ্গে এ ভাবে লাগাম ছাড়া ভাবে বেড়ে যাবে, কোনও দিন ভাবিনি। নবদ্বীপে সস্তায় মিষ্টি পাওয়া যায় বলে একটা সুনাম ছিল। দুধ থেকে জ্বালানিকিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় আর সে সুযোগ রইল না।” |
মঙ্গলবার স্থানীয় বাজারে দুধ বিক্রি হয়েছে ৩০-৩৫ টাকা কিলো দরে। নবদ্বীপের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী বিল্টু ঘোষ বলেন, “বহু দোকান ব্যবসায়ী ৪০ টাকা কিলো দরে দুধ কিনতে চেয়েও পাননি। তারা বাধ্য হয়ে এবার মিষ্টি করেননি।” কৃষ্ণনগরের তাপসবাবু বলেন, “সাধারণ সময়ে ছানা ৭০/৮০ টাকা কিলো দরে বিক্রি হয়। এখন ১৪০ টাকায় সেই ছানা কিনতে হয়েছে। জ্বালানির কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। ফলে ৫ টাকার নীচে আমাদের দোকানে কোনও মিষ্টি নেই। কেননা, দাম নীচে নামালে মিষ্টির যে সাইজ হবে, তা কেউ কিনবে না।” তিনি বলেন, “হাঁস সন্দেশ ১০ টাকা, পদ্মফুল ৯টাকা, কেশরভোগ-আবার খাবো-স্যান্ডউইচ, চিত্রকূট ৬টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।”
অন্য এক মিষ্টান্ন নির্মাতা বাণী ঘোষ বলেন, “গত বারের তুলনা করলে নিজেরাই বুঝতে পারবেনচিনি আগে ৩১টাকা দর ছিল। এখন ৪০ টাকা কিলো। কমার্শিয়াল গ্যাস সিলিন্ডার ১২০০ টাকা বেড়ে ১৬২৬ টাকা হয়েছে। কয়লা প্রায় ৫০০ টাকা। কাঠ ১৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা কুইন্ট্যাল হয়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে কারিগরের দৈনিক মজুরি ১৫০-২০০ টাকা। এর পরে আপনাকে মিষ্টি বিক্রি করে লাভ করতে গেলে দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় কী? তাঁর দোকানে পদ্মফুল সন্দেশ ১০ টাকা, ক্রিমচপ ১০ টাকা। ভাইফোঁটার বিশেষ মিষ্টি ৬ টাকা।
এদিকে বুধবার ছিল অন্নকূট। কালীপুজো-অন্নকূট এবং ভাইফোঁটা পর পর তিন দিন তিনটি বড় উৎসব পড়ে যাওয়ায় বাজার ছিল অগ্নিগর্ভ। ফল থেকে সব্জি। সবেতেই দাম শুনে কার্যত আঁতকে উঠেছেন ক্রেতারা। জিনিস কেনা নিয়ে তিক্ততাও তৈরি হয়েছে। বিক্রেতাদের অভিযোগ, সবচেয়ে বেশি সমস্যা খুচরো পয়সা নিয়ে। খুচরোর অভাবে ব্যবসা করা দায় হয়ে পড়েছে। নবদ্বীপ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক উত্তম সাহা বলেন, “খুচরোর কারণে সবচেয়ে সমস্যা পড়ছেন মিষ্টি ব্যবসায়ীরা।” মূল্যবৃদ্ধির জেরে কাটছাঁট হয়েছে বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের অন্নকূটের রাসে। নবদ্বীপের রায়দেব মন্দিরের কিশোর গোস্বামী বলেন, “হাজার মানুষের উৎসবের যে খরচ, তাতে একটু রাশ তো টানতে হয়েছে। পরিমাণে সামঞ্জস্য রেখে এবারের অন্নকূট হয়েছে। প্রতিটি জিনিসের দাম অকল্পনীয় ভাবে বেড়েছে।” প্রসাদের মান বজায় রাখতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে। শুধু অন্নকূট নয়, আগামী দিনের রাস বা দোল উৎসবেও আড়ম্বর কমাতে হবে। ক্রেতারা এদিন সকাল থেকেই ব্যবস্থ থেকে ভাইফোঁটার প্রস্তুতিতে। কিছু সংখ্যক অবশ্য ‘দাম বাড়লে কি আর করা যাবে! তাই বলে উৎসব তো থেমে থাকবে না’ গোছের কথা বললেও অধিকাংশ মানুষের মুখে উল্টো সুর। মিষ্টির দোকানে দাঁড়িয়ে খানিকটা অসহায় ভাবেই অরুন্ধতী সাহা বলেন, “একটা নির্দিষ্ট টাকা নিয়ে এসেছি। কিন্তু কিছুতেই সবটা গুছিয়ে উঠতে পারছি না। আর কত কমাব, শেষে তো প্লেটের একটা কোণায় পড়ে থাকবে মিষ্টি।” |