রাত গড়াতেই জাগল শব্দদানব |
নিজস্ব সংবাদদাতা •দুর্গাপুর ও আসানসোল |
শব্দবাজি বন্ধের আইন চালু হয়েছে দেড় দশক আগে। কিন্তু কালীপুজোয় শব্দবাজির রমরমা এখনও অটুট।
দীপাবলি রাতের অভিজ্ঞতা অন্তত তা-ই বলছে। গত বারের চেয়ে শব্দাসুরের তাণ্ডব কোথাও কোথাও কিঞ্চিত কমেও থাকতে পারে। কিন্তু দুর্গাপুর ও আসানসোল শিল্পাঞ্চলের বাতাস ভারী হয়েছে সালফার ডাই-অক্সাইডে।
শব্দবাজি ঠেকাতে এ বার গোড়া থেকেই তাল ঠুকছিল আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট। কোন কোন শব্দবাজি ক্ষতিকর তার তালিকা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছ থেকে জোগাড় করে থানায়-থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই তালিকা ধরে থানাগুলি অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু শব্দবাজি ধরাও হয়েছে। কিন্তু তা যে হিমশৈলের চুড়ো মাত্র, তা সন্ধ্যা নামতে না নামতেই প্রমাণ হয়ে গেল।
মঙ্গলবার রাত ৮টা নাগাদ আসানসোলের কল্যাণপুর এলাকা থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কার্যালয়ের কন্ট্রোল রুমে ফোন যায়, এলাকায় ব্যাপক শব্দবাজি ফাটছে। খুব কষ্ট পাচ্ছেন বাসিন্দারা। পর্ষদ খবর দেয় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। আসানসোল উত্তর থানার পুলিশ গিয়ে লাগাম টানে। বন্ধ হয় বাজি ফাটানো। একটি-দু’টি নয়, এই রকম বেশ কিছু অভিযোগ এসেছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আসানসোল শাখার আধিকারিক অঞ্জন ফৌজদার জানিয়েছেন, শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগে ফোন এসেছে কল্যাণপুর, বরাকর, বার্নপুর, রূপনারায়ণপুর ও রানিগঞ্জ থেকে।
নাগরিকেরা জানাচ্ছেন, বিকেল থেকেই আসানসোল শহরের আনাচে-কানাচে প্রচুর নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশির ভাগ এলাকার মানুষই তা সহ্য করেছেন। বেশি রাত পর্যন্ত যে সব জায়গায় বাজি ফেটেছে মূলত সেই সব অঞ্চল থেকেই পর্ষদ ও পুলিশের কন্ট্রোল রুমে অভিযোগ এসেছে। আসানসোলের বস্তিন বাজার, কল্যাণপুর, হাসপাতাল রোড, আপকার গার্ডেন, রাধানগর রোড, রবীন্দ্রনগর, বার্নপুরের স্টেশন রোড, পুরনো হাট, বরাকর, নিয়ামতপুর অঞ্চলে ব্যাপক শব্দবাজি ফেটেছে বলে অভিযোগ। অঞ্জনবাবু বলেন, “টেলিফোনে যাঁরা অভিযোগ জানিয়েছেন, প্রত্যেককেই নির্দিষ্ট ভাবে লিখিত অভিযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তা পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা নেব।” |
পরিস্থিতি প্রায় একই ছিল দুর্গাপুরেও। বেনাচিতি, সিটি সেন্টার, বিধাননগর প্রভৃতি এলাকায় বাজি ফেটেছে গভীর রাত পর্যন্ত। তবে অনেকের মতেই, এ বার বাজির সংখ্যা গত বারের তুলনায় অনেক কম ছিল। কালীপুজোয় বরাবরই বেনাচিতি এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাজি ফাটে। সেখানকার শ্যামল মণ্ডলের বক্তব্য, “গত বার দরজা-জানালা বন্ধ রেখেও শব্দদানবের অত্যাচার থেকে রেহাই মেলেনি। এক-এক বার মনে হচ্ছিল, এর কি আর শেষ হবে না? এ বার কিন্তু সহ্যসীমার মধ্যেই ছিল।” একই কথা জানিয়েছেন সিটি সেন্টারের নন-কোম্পানি এলাকার সুনন্দ সমাদ্দার বা বিধাননগরের সেক্টর ২-সি এলাকার শর্মিষ্ঠা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ইস্পাতনগরীর রানা প্রতাপ রোডের বাসিন্দা কৌশিক মুখোপাধ্যায়ের মতে, “প্রশাসন সক্রিয় থাকায় শব্দবাজি অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তবে আরও কড়াকড়ি দরকার। এমনিতেই শিল্প-কারখানার দূষণে অতিষ্ঠ শহরবাসী। বাজি পুড়লে দূষণের মাত্রা আরও বাড়ে।”
দীপাবলিতে বাজি পোড়ায় বাতাসে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে, তা ২০০৯ সাল থেকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করেছে দুর্গাপুর পরিবেশ দফতর। বাজি ফাটলে বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে। প্রাথমিক ভাবে পরিবেশ দফতরের স্বয়ংক্রিয় পরিমাপ যন্ত্রের হিসাব বলছে, গত কয়েক দিনে বাতাসে সালফার-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণে খুব একটা হেরফের হয়নি। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক আধিকারিক জানান, গত বছর কালীপুজোর রাতে বেনাচিতির বাতাসে সালফার-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ছিল ২৬.৩ মাইক্রোগ্রাম প্রতি মিটার কিউব। বি সি রায় রোডে তা ছিল ২৪.৪, বিধাননগরে ২০.২। সেখানে এ বার ধরা পড়েছে মাত্র ১০.১২ মাইক্রোগ্রাম প্রতি মিটার কিউব। |
আসানসোল-দুর্গাপুরের এডিসিপি (পূর্ব) সুনীল যাদবের ব্যাখ্যা, পুজোর আগে থেকেই লাগাতার অভিযান চালানো হয়েছে। কালীপুজোর সপ্তাহখানেক আগে থেকে তা আরও জোরদার করা হয়। দুর্গাপুরের তিনটি থানা এলাকা থেকেই প্রচুর শব্দবাজি আটক হয়। কালীপুজোর রাতে পুলিশের বিশেষ টহলদার বাহিনী ঘুরে বেরিয়েছে শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। তারই ফল মিলেছে। এডিসিপি (সেন্ট্রাল) সুরেশ কুমার জানান, আসানসোল দক্ষিণ ও উত্তর, জামুড়িয়া এবং রানিগঞ্জ এলাকায় শব্দবাজি বিক্রি ও জুয়ার ঠেক চালানোর অভিযোগে ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশ কিছু শব্দবাজি আটক হয়েছে। এডিসিপি (পশ্চিম) সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন, বার্নপুর অঞ্চল থেকে শব্দবাজি-সহ কয়েক জন বিক্রেতাকে আটক করা হয়েছে।
দীপাবলিকে নির্মল আলোয় ভরিয়ে তুলতে এখনও অনেক রাস্তা যেতে হবে...। |