শব্দবাজি, জুয়ার প্রকোপে জেরবার জেলা |
শব্দাসুর দাপাল দীপাবলির রাতে। মঙ্গলবার বর্ধমানের শিল্পাঞ্চলের অনেকটা, হাওড়ার উলুবেড়িয়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ, মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে কান ঝালপালা হয়েছে বলে অভিযোগ মানুষের। বেআইনি বাজি বিক্রি এবং ফাটানোর অভিযোগে কালীপুজোর রাতে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৯১ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আসানসোল দক্ষিণ, আসানসোল উত্তর, জামুড়িয়া ও রানিগঞ্জ এলাকা থেকে শব্দবাজি বিক্রির ও অবৈধ জুয়ার ঠেক চালানোর অভিযোগে জনা উনিশকে ধরা হয়েছে। বর্ধমান, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদের মতো একাধিক জেলা থেকে প্রচুর অবৈধ বাজি এবং বাজির মশলা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আবার উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা, হুগলির চুঁচুড়া, বাঁকুড়া শহরে বেআইনি শব্দবাজির তাণ্ডব অন্য বারের তুলনায় কম ছিল বলে জানিয়েছে জনতাই।
শব্দবাজি ঠেকাতে এ বার গোড়া থেকেই তাল ঠুকেছিল আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট। কোন কোন শব্দবাজি ক্ষতিকর, তার তালিকা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছ থেকে জোগাড় করে থানায়-থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই তালিকা ধরে থানাগুলি অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু শব্দবাজি ধরাও হয়েছে। কিন্তু তা যে হিমশৈলের চুড়ো মাত্র, তা কালীপুজোর সন্ধ্যা নামতে না নামতেই প্রমাণ হয়ে যায়। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের আসানসোল শাখার অধিকারিক অঞ্জন ফৌজদার জানিয়েছেন, আসানসোলের কল্যাণপুর, বরাকর, বার্নপুর, রূপনারায়ণপুর ও রানিগঞ্জ থেকে শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগ সংক্রান্ত ফোন তাঁরা পেয়েছেন।
পরিস্থিতি প্রায় একই ছিল দুর্গাপুরেও। শহরের বেনাচিতি, সিটি সেন্টার, বিধাননগর প্রভৃতি এলাকায় বাজি ফেটেছে গভীর রাত পর্যন্ত। তবে কিছু বাসিন্দার মনে হয়েছে, এ বার বাজির সংখ্যা গতবারের তুলনায় অনেক কম ছিল। কালীপুজোয় বরাবর বেনাচিতি এলাকায় সবচেয়ে বেশি বাজি ফাটে। সেই বেনাচিতির শ্যামল মণ্ডল বলেন, “গত বার দরজা-জানালা বন্ধ রেখেও শব্দ দানবের অত্যাচার থেকে রেহাই মেলেনি। এক এক বার মনে হচ্ছিল, এর কি আর শেষ হবে না! এবার কিন্তু সহ্যসীমার মধ্যেই ছিল।”
শব্দদানব প্রায় বোতলবন্দি ছিল উত্তর ২৪ পরগনার হাবরায়। দিন কয়েক আগেই লক্ষীপুজোয় বাজির তাণ্ডবে কার্যত অলিখিত বন্ধ পালিত হয়েছিল হাবরায়। এ বার অবশ্য সেখানে ‘পরিবর্তন’-এর ছবি। গত ৪ নভেম্বর হাবরা পুরসভায় পুলিশের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক বৈঠকে কালীপুজোর উদ্যোক্তারা ছাড়াও ছিলেন পুরসভার চেয়ারম্যান তপতী দত্ত, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জমির হোসেন-সহ সংশ্লিষ্টেরা। ছিলেন এসডিপিও (বারাসত) সুবীর চট্টোপাধ্যায়। বৈঠকে থানার আই সি অনিল রায় জানিয়ে দেন, এলাকায় শব্দবাজি বিক্রি ও ফাটানো হলে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা করা হবে। এ বার ১০টি কালীপুজোর উদ্বোধনে গিয়ে অনিলবাবু উদ্যোক্তা এবং সাধারণ মানুষের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, শব্দবাজি না ফাটাতে। এলাকাবাসীর দাবি, প্রচারে ফল হয়েছে। ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর হাবরা শাখার সম্পাদক শঙ্কর সরকারের অভিজ্ঞতা, “এ বার কালীপুজোয় খুবই কম শব্দবাজি ফেটেছে। এই কৃতিত্ব পুলিশ-প্রশাসনের।”
হাওড়ার উলুবেড়িয়া, বাগনান, বাউড়িয়াপ্রায় সর্বত্রই দেদার শব্দবাজি ফেটেছে। আবার পাশের জেলা হুগলির চুঁচুড়া, ব্যান্ডেল, চন্দনগর এলাকায় কালীপুজোর রাতটা অন্য বারের তুলনায় কম শব্দময় ছিল বলে জানা গিয়েছে। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর মহকুমা এলাকাতেও গত বছরের তুলনায় শব্দ-দৈত্যের তাণ্ডব কিছুটা কমেছে বলে দাবি করেছে প্রশাসন। আবার পুলিশ-প্রশাসনের নজরদারির মধ্যেও শব্দবাজি ফেটেছে মেদিনীপুর-খড়্গপুর, এই দুই শহর ও শহরতলিতে। কয়েকটি এলাকায় বেশ রাত পর্যন্ত বাজি ফাটায় সমস্যায় পড়েছেন এলাকাবাসী। কিন্তু নজরদারি চালিয়েও শব্দবাজির তাণ্ডব ঠেকানো গেল না কেন? সরাসরি জবাব মেলেনি জেলা পুলিশের কর্তাদের কাছেও। মেদিনীপুরের একাধিক বাসিন্দার মতে, “শুধু নজরদারি চালিয়ে শব্দবাজি ফাটানো বন্ধ করা যাবে না। শহর ও শহরতলিতে বিকট শব্দের বাজি বিক্রি করা বন্ধ করা দরকার।”
বহরমপুরের বিষ্ণুপুরের রাস্তায় আধ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে ৪টে পুজো হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত আড়াইটে পর্যন্ত লাগামছাড়া ভাবে শব্দবাজি ফেটেছে ওই এলাকায়। বহরমপুর ক্যান্টনমেন্ট রোডে টেক্সটাইল মোড় থেকে মোহনের মোড় পর্যন্ত রাস্তায়, লালদিঘি পাড়ায়, খাগড়া-নতুন বাজার, সৈয়দাবাদ, কাশিমবাজার পাড়ায় বাজির শব্দে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরবন্দি থাকতে বাধ্য হয়েছেন এলাকার মানুষ। কান্দি শহর, বড়ঞা, ভরতপুর, সালার, খড়গ্রাম থানা এলাকায় শব্দবাজির উৎপাত ছিল তুলনায় কম। মহকুমাশাসক (কান্দি) দীপাঞ্জন ভট্টাচার্যের দাবি, “শব্দবাজি এ বার ফাটেনি বললেই চলে। প্রশাসনের লাগাতার সচেতন করার প্রচেষ্টা অনেকটা কাজ করেছে বলেই মনে হচ্ছে।” |