নুরুল আবসার • জগৎবল্লভপুর |
হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের মুন্সিরহাটে বিডিও অফিস চত্বরের পিছন দিকে খান পঞ্চাশ চশমা কারখানা। তারই একটায় মন দিয়ে কাজ করছিল সাহিল খান। দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরটায় দিনের বেলাতেও সূর্যের প্রবেশ নিষেধ। জানলাই নেই। টিমটিম করে জ্বলছে ৬০ ওয়াটের বাল্ব। পেল্লায় টেবিল। সেখানে রাখা কয়েক জোড়া গোল করে কাটা কাচ। গ্রাইন্ডিং মেশিনের সাহায্যে সেই কাচ ঘষছে সে। ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন মতো ওই কাচে নির্দিষ্ট ‘পাওয়ার’ দেওয়ার কাজে ব্যস্ত সাহিল। মুশকিল একটাই, মেঝে থেকে টেবিলের যা উচ্চতা, তাতে আট বছরের সাহিলকে দাঁড়াতে হয়েছে একটা টুলের উপরে। বয়স যে তার মাত্র আট বছর।
পাশের কারখানায় কাজ করে বছর তেরোর শেখ সুরজ। বাবা ভ্যান রিকশা টানেন। স্কুলে ভর্তি হয়েছিল সুরজ, এখন চশমা কারখানায়। দাদা মিরাজের বয়স ষোলো। সে-ও একই পেশায়।
জগৎবল্লভপুরে চশমা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত বহু শিশু শ্রমিক। সকলেরই অভাব-অনটনের সংসার। সফি রহমান নামে এক কারখানা মালিক বললেন, “আমরা শিশু শ্রমিকদের কাজে নিতে চাই না। কিন্তু আমি না নিলে কী হবে। ক’দিন পরে দেখব অন্য কারখানায় কাজ পেয়ে গিয়েছে।” মালিকেরা জানালেন, মুন্সিরহাট-সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে ঘরে ঘরে চশমার কাচ তৈরি হয়। কোথাও কাজ মিলেই যাবে। |
হাওড়া জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, ২০০৯ সাল থেকে হাওড়া জেলায় শিশু শ্রমিকদের জন্য ৩৪টি স্কুল চলছে। মিড ডে মিলও দেওয়া হয়। ১৫০ টাকা মাসিক ভাতা মেলে। জগৎবল্লভপুরের এই এলাকাতেও আছে এমন একটি স্কুল। কিন্তু সে ব্যাপারে ওয়াকিবহালই নয় চশমা কারখানার শিশু শ্রমিক বা তাদের অভিভাবকেরা। মহকুমাশাসক (হাওড়া সদর) বাণীপ্রসাদ দাস বলেন, “জগৎবল্লভপুরে শিশু শ্রমিকদের জন্য একটি স্কুল আছে। তা সত্ত্বেও চশমা কারখানার শিশু শ্রমিকেরা সেখানে পড়তে যাচ্ছে না কেন, বিস্তারিত খবর করতে হবে। খুব শীঘ্রই ওই কারখানার মালিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসব। অভিভাবকদেরও ডাকা হবে।” অর্থাৎ, যত দিন প্রশাসন না নড়ে বসবে, তত দিন চলবে এই ব্যবস্থা।
কত মজুরি দিতে হয় শিশু শ্রমিকদের? মালিকরা জানালেন, সপ্তাহে ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্তও মজুরি পায় ছোট ছোট ছেলেরা। এখান থেকে ‘পাওয়ার’ দেওয়া চশমা চলে যায় কলকাতা ও লাগোয়া জেলার বিভিন্ন দোকানে। বড়দের কী মজুরি বেশি? মালিকেরা জানালেন, দু’একশো টাকা বেশি দিতেই হয় পূর্ণবয়স্ক শ্রমিকদের। তাই চশমা শিল্পে কদর বেশি শিশু শ্রমিকদের।
অভিভাবকরা কি চুপ? শেখ রাজা-সহ অনেক অভিভাবক বলেন, অভাবের সংসার। ছেলে যা রোজগার করবে, তা-ই লাভ। শেখ ইসমাইল ও তাঁর ছেলে কাজ করেন একই চশমা কারখানায়। ইসমাইলের কথায়, “বাপ-ছেলে মিলে সপ্তাহে প্রায় ৮০০ টাকা রোজগার করি। দিব্যি চলে যাচ্ছে।”
এমনই কি চলবে? যে শিশুদের হাতে তৈরি চশমার কাচ দিয়ে দেখছে বড়রা, তাদের দুর্দশা কবে বড়দের নজরে পড়বে? |