স্মৃতিপথ বেয়ে অতীতের একটি মুহূর্তে ফিরে যাচ্ছি। ১৯৫৮ বা ১৯৫৯ সাল। প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের পুত্র আনন্দরূপ রায়ের সঙ্গে কথা বলছি। বিষয়টা জরুরি। আমাদের ডাক পড়েছে আকাশবাণীতে, কোনও স্বনির্বাচিত নতুন বই নিয়ে আলোচনা করার জন্য। আমরা স্বাভাবিক ভাবেই উত্তেজিত। আকাশবাণীতে বলতে আনন্দরূপের সঙ্গে গিয়েছিলাম। তিনি কোন বই নিয়ে বলেছিলেন? মনে নেই। আমি বলেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম বই ‘একা এবং কয়েকজন’ সম্পর্কে।
কী বলেছিলাম? খুঁটিনাটি মন থেকে মুছে গেছে। যদি সঙ্গে কোনও কাগজ নিয়ে গিয়ে থাকি তা-ও পৃথিবীর মধুময় ধূলিতে কবেই বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু সুনীলের সর্বপ্রথম বই কলকাতার বেতারে রিভিউ করেছিলাম, তাই নিয়ে আজও গর্ব আছে আমার।
তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ‘কবিতা’ পত্রিকার পাতায়। আবু সয়ীদ আইয়ুব সম্পাদিত ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ সংকলনে (১৯৫৬) সর্বশেষ কবিতাটি ছিল সুনীলের ‘আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনে দিলে/ তোমার দু চোখে তবু ভীরুতার হিম।’ কবিতাটি আমার মুখস্থ ছিল। সেই ব্রাহ্মমুহূর্তে আমাদের প্রজন্মের দিগন্তে সুনীল তরুণতম প্রতিশ্রুতিময় কবি। ছাপ্পান্নতে তাঁর কোনও বইও বেরোয়নি।
এখন যখন ‘একা এবং কয়েকজন’ খুলি, খেয়াল না করে পারি না তার কত কত লাইন গুচ্ছ-গুচ্ছ লাইন আমার স্মৃতিস্থ। উচ্চারণের এক আশ্চর্য স্মরণীয়তা নিয়ে কানে আছড়ে পড়েছিল এ কবির ভাষা, অত্যাধুনিক ভাবভঙ্গি; অপ্রত্যাশিত, চমকপ্রদ শব্দগ্রহণ; ছন্দের আচমকা-ধাক্কা-দেওয়া টানটোন। কত কবিতার প্রথম লাইন পড়লেই বাকিটা কানে চেনা সুরের মতো বেজে ওঠে। ‘তুমি কবিতার শত্রু কবিতার মদির সৌরভ/ মুহূর্তেই মুছে যায় তুমি এলে আমার এ ঘরে...’; ‘ঝড় দিস্নে, আকাশ, সেই সুন্দরীর ঘরে...’; ‘রৌদ্রে এসে দাঁড়িয়েছে রৌদ্রের প্রতিমা...’; ‘সমস্ত আকাশ থেকে রাত্রি আর বৃষ্টি ঝরে পড়ে...’; ‘কিছু উপমার ফুল নিতে হবে নিরুপমা দেবী...’; ‘যদিও জীবনে অনেক মাধুরী করেছি হরণ...’; ‘এপ্রিলের কৃষ্ণচূড়া অহংকারে ব্যাপ্ত করে দিক...’। |
সাহচর্য। স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুনীল। অক্টোবর ১৯৯৯ |
সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ সত্ত্বেও সুনীল বলতেন কবিতাই ছিল তাঁর অন্তরের অন্তঃসলিল ভালবাসা। আমাকে এক বার অকপটে বলেছিলেন জানি, বেশি লিখে ফেলেছি, এত বেশি লেখা ঠিক নয়, লেখার স্ট্যান্ডার্ড রাখা যায় না, কিন্তু জীবিকার জন্যেই লিখতে হয়েছে; জেদ ছিল লিখেই স্বাতীকে আরামে রাখব, ছেলেকে টিনটিনের কমিক কিনে দেব। তাঁর স্বভাবের মধ্যে সারল্য, দুষ্টুমি, কৌতুকবোধের একটা ছেলেমানুষ-সুলভ মিশ্রণ ছিল। তার উচ্চারণ শোনা যায় তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বইয়ের একটি কবিতায়, যেখানে তিনি ঘোষণা করেন: ‘এ বার কবিতা লিখে আমি একটা রাজপ্রাসাদ বানাব’। ‘কবিতা লিখেছি আমি চাই স্কচ, সাদা ঘোড়া, নির্ভেজাল ঘৃতে পক্ব/ মুরগির দু’ঠ্যাং শুধু, বাকি মাংস নয়।’ ওই তালিকার মধ্যে একমাত্র ‘স্কচ’ শব্দটা জানান দেয় যে এই উক্তি এক জন যুবকের, একটি বাচ্চা ছেলের নয়।
তাঁর কবিতায় যৌবনযন্ত্রণার অনাড়ষ্ট প্রকাশের পাশাপাশি নারী-বিষয়ে একটা দ্বন্দ্বও দৃশ্যমান। জিনিসটা কেবল ব্যক্তির ব্যাপার নয় কিন্তু, মানুষের সামাজিক জীবনের সঙ্গেও অন্তরঙ্গ ভাবে জড়িত। হাল আমলে নারীর আত্মকথনের অধিকার কিছুটা স্বীকৃতি লাভ করেছে, কিন্তু পুরুষের স্বগতোক্তির দিকটা কি একটু অবহেলিত? উভয় লিঙ্গকেই আমাদের বুঝতে হয়। একই মানুষের মধ্যে যে বালক আর যুবক বাস করে, যথাসময়ে এক জন ক্লান্ত প্রৌঢ়ও যে সেখানে যোগ দেয়, এটা না বুঝলে আমাদের বিচারে সূক্ষ্মতা বা পরিণতি আসে না।
সুনীলের সঙ্গে আমার মুখোমুখি পরিচয় ১৯৭৬ সালে, আনন্দবাজারের সাগরময় ঘোষের ঘরে। তখনও আমার কোনও কবিতার বই বেরোয়নি। সাগরদা চান আমার প্রথম বই ‘আনন্দ’ থেকে বেরোক। তিনি সুনীলকে ডেকে পাঠিয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করে দিলেন। সেই সময়ে বুঝতে পেরেছিলাম যে যোগাযোগ না থাকলেও সুনীল আমার লেখা পড়েন। মনে ভরসা পেয়েছিলাম। তাঁর দ্বিতীয় কবিতার বইয়ে একটি কবিতার নাম ‘নারী ও নগরী’। আমার ‘নারী, নগরী’ ওই কালপর্বেই ‘দেশ’-এ ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল। তাঁর বিষয়বস্তু একেবারে আলাদা, কিন্তু আমার শিরোনামটা তাঁকে নাড়া দিয়ে থাকবে। তাঁর কবিতার ‘নীরা’কে শব্দের বিকল্প বিন্যাস (ইংরেজি মতে ‘অ্যানাগ্রাম’) বলেই মনে হয় আমার।
প্রত্যক্ষ পরিচয়ের পর সুনীল মধ্যে মধ্যে আমাকে তাঁদের গোষ্ঠীর আড্ডায় নিয়ে যেতেন। সাধারণত সেখানে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর তাঁদের উভয়ের প্রকাশক ব্রজকিশোর মণ্ডল থাকতেন। শক্তি মধ্যে মধ্যে টলোমলো হয়ে গেলে সুনীলকে সামাল দিতে হত। এক বার একটা ক্যাফের ভিতরে শক্তি ব্রজকে চেপে ধরে বললেন, ‘হিসেব দে।’ বই বিক্রি আর রয়্যালটির হিসাব। ব্রজ বললেন, ‘আমি কি পকেটে হিসেব নিয়ে ঘুরি, অফিসে আয়, তখন দেব।’ শক্তি নাছোড়, হিসেবটা তাঁর তখুনি চাই। সে-যাত্রা সুনীল কত কাণ্ড করে শক্তিকে ঠাণ্ডা করেছিলেন তা আমার সরজমিনে দেখা। সেই সব আড্ডায় সুনীলকে কখনও টলোমলো দেখিনি। মাথা ঠাণ্ডা থাকত তাঁর। আমেরিকা-ফেরত সুনীল মেলামেশার আধুনিক আঙ্গিকে বিশ্বাস করতেন। আমি যদিও তাঁর থেকে ছ’বছরের ছোট, তাঁকে নাম ধরে ডাকবার আর ‘তুমি’ বলবার অধিকার দিয়েছিলেন। আড্ডাগুলো যাতে নিছক পানের আসর না হয়ে যায় সে দিকে নজর রাখতেন। তাঁর সঙ্গীদের বলতেন, ‘এই তোমরা সালামি আনাও। কেতকী বিলেতের লোক, ওরা সলিড সঙ্গে না থাকলে শুধু শুধু লিকুইড খেতে পারে না।’
সুনীলের স্ত্রী স্বাতী আমার দুটি নাটকে অভিনয় করেন। সেই সময়ে তাঁদের কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়, স্বাতীকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্যও হয়। তাঁদের ফ্ল্যাটে রিহার্সালের কত আনন্দময় দিন কেটেছে। আমার প্রথম নাটকের উদ্বোধন বিলেতেই হয়। লন্ডনের মঞ্চায়ন দেখতে এসেছিলেন সুনীল। শিল্পসাহিত্যের ব্যাপারে সাহায্য করতে তৎপর ছিলেন তিনি। ২০০২-এ কলকাতায় আমার দ্বিতীয় নাটকের উদ্বোধনের সময়ে উদ্যোক্তারা চাইলেন যে আমি নিজের কবিতা কিছু পড়ি, কেননা, কলকাতার পাঠকরা আমার স্বকণ্ঠে কবিতাপাঠ শোনার সুযোগ পান না। সুনীল সভাপতিত্ব করলেন, আমার সম্বন্ধে অনেক ভাল ভাল কথা বললেন! তখন তাঁর গুণগ্রাহিতার পরিচয় পেয়েছি। ২০০৮-এ বুদ্ধদেব বসুর জন্মের শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে দিল্লিতে একটা অনুষ্ঠান করা দরকার, বিলেত থেকে কী করে তার ব্যবস্থা করা যায় বুঝতে পারছি না। ভারতীয় ইংরেজির কবি কেকি দারুওয়ালা আমাকে সুনীলের মোবাইল নম্বরটা দিয়ে অবিলম্বে তাঁকে ফোন করতে বললেন। সুনীলকে যখন ধরলাম তখন তিনি সাহিত্য অকাদেমির ভবনে একটা সভার ব্যবস্থা করতে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। সবর্ভারতীয় স্তরে এই ধরনের উদ্যোগে তাঁর অভাব আমরা অনুভব করব।
সুনীল-স্বাতীর সঙ্গে শেষ দেখা বাল্টিমোরে ২০১১-র বঙ্গ-সম্মেলনে। সুনীলকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে। ধ্বস্ত স্বাস্থ্য নিয়েও লেখকদের কী ভাবে মদত দেওয়া যায় সে-ব্যপারে তাঁর টনক ছিল। তিনি আমাকে সেখানে বসতে বললেন। তাঁর কাছে বসে পড়লাম বলে আমার বইয়েরও বেশ কপি দ্রুত বিক্রি হয়ে গেল। সত্যিই বুঝদার ছিল তাঁর সৌহার্দ্য। |