নাগাড়ে দশকের পর দশক ধরে আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে যাদের তীব্র বিরোধিতা করে তিনি মহাকরণে আসীন হয়েছেন, সেই সি পি এমের দেখানো পথই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথ, তা নিয়ে অনেকেরই এখন আর সংশয় নেই। নাগরিক সমাজের একাংশ এ কথা মানছেন, এমনকী পরিবর্তনের পক্ষে যাঁরা সরব হয়ে উঠেপড়ে সওয়াল করেছিলেন, তাঁদেরও অনেকে কথাটা মেনে নিয়েছেন।
চক্রান্ত? অপপ্রচার? বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা? হলে হয়তো পশ্চিমবঙ্গের ভালই হত, কারণ মিথ্যা সমালোচনা দিয়ে তো আর আসল উন্নতি আটকানো যেত না! তাই দেখতাম, অপবাদের মুখে ছাই দিয়ে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী হনহন করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। কিন্তু সমাজতত্ত্বের বিশেষজ্ঞও যখন একই কথা বলেন, তখন সত্যিই ভয় হয়। আমরা না-হয় নিন্দুক, কিন্তু রামচন্দ্র গুহ তো তা নন, তাঁকে তো, আর যা-ই হোক, সি পি এমের লোকও বলা যাবে না!
বুধবার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট, কলকাতার প্রেক্ষাগৃহে দাঁড়িয়ে রামচন্দ্র গুহ বললেন, “পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় ও সংবেদনশীল নাগরিক সমাজের অভাব প্রকট। এই রাজ্যে কখনও এটা গড়ে উঠতে পারেনি কেননা প্রথমে কমিউনিস্টরা সেটা করতে দেয়নি। আর আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই কাজ করছেন। তিনিও চান না, শক্তিশালী কোনও নাগরিক সমাজ এখানে গড়ে উঠুক। অথচ বর্তমানে ভারতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আসনটি দাঁড়িয়ে আছে তিনটি পায়ার উপর প্রশাসন, বেসরকারি ক্ষেত্র ও নাগরিক সমাজ। তৃণমূল কংগ্রেস সম্পর্কে আমার সমালোচনার মূল জায়গাটা হল, তারাও এখন এই মানসিকতা নিয়ে চলছে যে, যদি তুমি আমার সঙ্গে না থাকো, তার অর্থই হল, তুমি আমার বিরোধী। এটা কিন্তু ভয়ঙ্কর ভুল হয়ে যাচ্ছে। নাগরিক সমাজকে দমিয়ে রাখার মানসিকতাটাই ভুল। এটা কখনওই মনে করা ঠিক নয় যে, পার্টিই সব জানে, রাইটার্স বিল্ডিংস থেকেই সব হবে।”
আরও একটি মন্তব্য করেছেন অধ্যাপক গুহ। সেই অভিমত তাঁর আগের সমালোচনাকে আরও জোরদার করে, আরও উদ্বেগজনকও। তাঁর কথায়, “ব্যক্তি-নির্ভর দলে সর্বময় নেতা বা নেত্রীর অবিসংবাদী কর্তৃত্ব সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে ক্ষতিকর। এর ফলে দেশে দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাব দেখা যাচ্ছে। যেমন এডিএমকে, যেমন বহুজন সমাজ পার্টি, যেমন তৃণমূল কংগ্রেস। জয়ললিতা যখন বসে থাকেন, তাঁর দলের অন্য মন্ত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ভাবা যায়? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই পথেই হাঁটছেন। তিনি কি আদৌ কারও কাছ থেকে পরামর্শ নেন?”
রামচন্দ্র গুহ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নন। তিনি রোজ দেখেন না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহকর্মীদের, যাঁরা অনেকেই বয়সে ও অভিজ্ঞতায় তাঁর চেয়ে প্রবীণ। দেখলে বুঝতে পারতেন, কাজ ফেলে নেত্রীর কাছে কাছে অষ্টপ্রহর ঘোরা, যে কোনও বক্তৃতায় বা সাক্ষাৎকারে বা বিবৃতিতে কারণে-অকারণে তাঁর নাম বার বার উচ্চারণই তাঁদের ধর্ম, কারণ তাতে নম্বর বাড়ে।
আইআইএমসি-র সুবর্ণজয়ন্তীর সমাপ্তি অনুষ্ঠানে শ্রীগুহর পর্যবেক্ষণের পর আশঙ্কা গভীরতর হয়, ভাবী ইতিহাস এ কথাই লিখবে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পার্টির স্বৈরাচার বদলে সেই জায়গায় এনেছিলেন এক ব্যক্তির স্বৈরাচার। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এটাই কি হবে তাঁর অবদান? |