বঙ্কিমচন্দ্র জমিদার, চাষি, পুরুষ-স্ত্রীজাতির মধ্যে কৃত্রিম প্রথাসৃষ্ট অ-প্রাকৃত বৈষম্যের বিরোধিতা করে অবশেষে ইংরেজের কর্মচারী হিসেবে সন্ত্রস্ত ভাবে লিখেছিলেন, ‘দেশী বিলাতীর মধ্যে সেই রূপ আর একটি অপ্রাকৃত বৈষম্য। কিন্তু সে কথার অধিক আন্দোলন করিতে পারি না’। আর শেষ জীবনে ঔপন্যাসিক হিসেবে সাফল্যের পর নাকি বলেছিলেন ‘‘‘সাম্য’ বইটা সব ভুল, খুব বিক্রয় হয় বটে, কিন্তু আর ছাপাব না’’। দেশি বিলাতির বৈষম্যটাই, বিশেষত ‘স্বাধীনতা’ লাভের পর থেকে ভারতীয় সমাজে কৃষ্টিগত ও শ্রেণিগত বৈষম্যের সব থেকে বড় রূপ ধারণ করেছে। উপনিবেশোত্তর রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক তত্ত্বের সাম্যবাদী তাত্ত্বিক দার্শনিক বুদ্ধিগুরুরা শুধু যে (আমার মতো) প্রয়াত রামচন্দ্র গাঁধীর ভাষায় নতুন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে মেতেছেন তা নয়, বার্লিন দেওয়াল ভাঙার পর মৌখিক মার্কসবাদের খোলসটুকু বাদে তাঁদের অনেকেই ধন ও ক্ষমতা বণ্টনের বৈষম্যের ভরসাতেই লেখালিখি ও তত্ত্বচর্চা করে চলেছেন। যখন নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, দারিদ্র সীমারেখা নীচে নামিয়ে দু’লক্ষ টাকা রোজ খরচা করে হাওয়াই জাহাজে চড়ে ঘুরে বেড়ালে আমার এত রাগ কীসের? আমি পারছি না বলে? নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন যখন ’৭৯ সালে যুগান্তকারী লেখা ‘কী বিষয়ে সমতা?’য় লিখেছিলেন, সুখস্বাচ্ছন্দ্যের নয়, রোজগারের নয়, মৌলিক অধিকারেরও নয়, নিজের ভাগ্য নিজে জয় করার সক্ষমতার সমতাই গণতন্ত্রে কাম্যতম, তখন নিশ্চয় তাঁরও জীবনযাত্রার মান কবীর সুমনের গানের হাভাতে রিকশাচালক অথবা পুরুলিয়ার কাঠফাটা রোদে খেতে কাজ করা দলিত মজুরের থেকে বহুশত গুণ উঁচুতে ছিল। কই তাতে তো আমার রাগ হয় না! বরং আমি কতটা অমর্ত্য সেনের কাছাকাছি নামডাক সচ্ছলতায় পৌঁছতে পারি, তার জন্য আমার ব্যগ্রতা আমাদের বাসন মাজার মহিলাটির মেয়েকে আমার মেয়ের সমপর্যায়ে তুলে আনার ব্যগ্রতার অনেক গুণ বেশি। তবে কি এ উৎক্রোশের অধিকাংশই নাটুকে আত্মপ্রবঞ্চনা? |
‘দি পটেটো ইটারস’। ১৮৮৫ সালের এপ্রিল মাসে এই চিত্রটি এঁকেছিলেন ভিনসেন্ট ভ্যান গখ।
এখন এটি আছে হল্যান্ডের আমস্টার্ডামে, ভ্যান গখ মিউজিয়মে। |
‘দার্শনিক ও তার গরিব মানুষ’ নামক একটি আশ্চর্য রকমের অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ গ্রন্থে জাক রান্সিয়ের সাম্যবাদী দার্শনিকদের এই ভণ্ডামিকে পদে পদে উন্মোচন করেছেন। তরুণ বঙ্কিম ও ক্যাপিটাল রচয়িতা মার্কসের মতো তিনিও বুঝেছিলেন, শ্রমিকের দিনান্তে অবসর যাপনের সময়ে যে শিল্পকাব্যকলার স্বতন্ত্র বিকাশ হয়, তারই সঙ্গে দর্শনচর্চার অধিকার ও নিজেকে নিজে শিক্ষিত করার অধিকারও নিচু তলার খাটিয়ে মানুষদের দিতে/পেতে হবে। রান্সিয়ের-এর প্রথম দিককার ইতিহাস-নথিপত্র ঘাঁটা কাজের নাম তাই ‘শ্রমের শর্বরী’। খাটুনির ঘণ্টাগুলি না কমালে শ্রমিক শিক্ষিত হবে না। যদি আমরা সত্যি-সত্যিই শ্রমিকদের নিজের কণ্ঠে বলা দর্শন ও কাব্য শুনতে পেতাম, শ্রমিকের জবানিতে দার্শনিক তাত্ত্বিকের কথা নয়, তবে জানা যেত বৈষম্যের দাঁত কী কুৎসিত ক্ষত তৈরি করেছে। কিন্তু একটি দুরূহ দার্শনিক অনুচ্ছেদ শেষে রান্সিয়ের লিখছেন, ‘শ্রমিক’ ধারণাটি যখন হাড়-মাংসের পোশাক পরে মূর্ত হয়ে দাঁড়ায়, তখন সেই ব্যক্তিগুলিকে তো পরিসংখ্যানে সমাজবৈজ্ঞানিক সামান্যীকরণে আর ধরা যায় না। ‘ওরা তো কথা বলে না। ওদের সময় নেই। ওরা বড্ড বেশি ক্লান্ত।’ (The Philosopher and his Poor, P.137)
শান্তি পর্বের অন্তর্গত আপদ্ধর্ম পর্বে যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অনৃশংসতা কেমন সে তো খানিকটা বুঝতে পারি, সর্বদা এত ধার্মিক সজ্জনদের দেখে দেখে। কিন্তু নৃশংস বলতে আপনি ঠিক কী ধরনের লোককে বোঝাচ্ছেন বলুন দেখি!’
ভীষ্ম যে জবাব দিলেন, তার তুলনা কেবল বোদলেয়ারের ‘Paris Spleen’ গল্পমালার ‘Eyes of the Poor’ গল্পটিতে মিলতে পারে। গলা কাটা, তির মারা, চাবুক মারার কথা বললেন না তিনি। বললেন, ‘‘যে উত্তম ভোজ্য, পেয়, লেহ্য আরও দামি দামি ভোগ্যদ্রব্য (না খেয়ে) চেয়ে থাকা মানুষদের মধ্যে বসে উপভোগ করে খায়, তাকেই ‘নৃশংস’ বলা উচিত।’’
কৃপণ, বলপ্রয়োগে প্রভুত্বকারী, অসংবিভাগী যারা সমবণ্টনে বিশ্বাসী নয়, নিজের গোষ্ঠী, জাতি বা বর্গকে প্রশংসা করে, দান করে ফলাও করে নিজের দানের কীর্তি ঘোষণা করে, তারাই নৃশংস। এই রকম নৃশংসতা ধর্মশিক্ষা বা নীতিশিক্ষার দ্বারা দূর হয় না। ভট্টনায়ক (অভিনব গুপ্তের পূর্বসূরি) বলেছিলেন, যে কোনও স্থায়ী ভাব, এমনকী ভয়, ঘৃণা, ক্রোধ, শোক রস হয়ে উঠে নিঃস্বার্থ নিরহংকার সুষমা সৃষ্টি করতে পারে, যখন তা সাধারণীকৃত হয়। এই সাধারণীকরণের সঙ্গে গীতা-মহাভারতের ‘সমত্বই যোগ’কে যোগ করে রুশো থেকে প্রুধোঁ পর্যন্ত যে বৈষম্যবিরোধী সমাজচিন্তা রয়েছে, তাকে ভারতীয় প্রজ্ঞার রসে পুনর্জীবিত করা সম্ভব।
এই রকমই এক পূর্ব-পশ্চিমের চিন্তার আশাতীত রাখিবন্ধন করে রবীন্দ্রনাথের ‘অপমান’ কবিতা থেকে সম্প্রতি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তুলে এনেছেন একটি সাম্যাভিমুখী নতুন চিন্তার সূত্র। তিনি অবশ্য মহাভারত, গীতা, বঙ্কিমের কথা ওই অধ্যায়ে তোলেননি। তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত নতুনতম গ্রন্থ ‘অ্যান এস্থেটিক এডুকেশন ইন্ দি ইরা অব গ্লোবালাইজেশান’ (হার্র্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১২)। তাতে তাঁর বক্তব্য জটিল হলেও মূল সুরটি অবধান করার মতন। বাংলার গ্রামে দলিত জনজাতীয় সর্বহারা কিশোর-কিশোরীদের প্রাথমিক শিক্ষার কাজে (এবং শিক্ষকশিক্ষণে) হাতেকলমে তাঁর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার আলোতে, আধুনিক ইংরেজি উপন্যাস কোয়েট্সিয়ের ‘অবমাননা’(Disgrace) পাঠন-পঠনের অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করে তিনি এই বইয়ে দুটি আদিবাসী কন্যার কথা বলেছেন। ১১ আর ১৫ বছরের মেয়ে দুটি গায়ত্রীকে দেখাতে এনেছে চতুর্থ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ‘আমাদের ইতিহাস’-এ কী পড়ছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য ও সাদা-কালোর পৃথগীকরণের বিরুদ্ধে নেলসন ম্যান্ডেলার নিরস্ত্র সংগ্রাম ও বিজয়ের কাহিনী। গায়ত্রী তাদের ‘সমান অধিকার’ বোঝাতে গিয়ে ক্রমাগত অস্বস্তিতে ভুগছেন। ৩৩১ পৃষ্ঠায় স্পিভ্যাক লিখছেন, ‘প্রায় দেড় ঘন্টা এই অংশটি নিয়ে লড়ে যাবার পর আমি আমার হাত ওই একটু দীপ্ততরা বুদ্ধিমতী বালিকার প্রায় বেগুনি-কালো হাতের পাশে রেখে বর্ণভিত্তিক পৃথগীকরণ বোঝাতে গেলাম। ওর ঝকঝকে কালো হাতের পাশে আমার ফ্যাকাশে খয়েরি হাত কেমন যেন সাদা দেখাল। ম্যান্ডেলার ‘সমান অধিকার’ বোঝাতে গিয়ে হঠাৎ মাথায় এল বলি, “আমি যা, তুমি তা।” কনিষ্ঠ বুদ্ধিমতী মেয়েটি সহজেই বুঝে গিয়ে বলল, ‘‘আমি যা, তুমি তা, রাজা হেরে গেছে।”
আদিবাসী শিশুদের ‘সমত্ব’ বা ‘সমরস’-এর সুষমা শেখানোর অধিকার লাভের জন্য তাঁকে শুধু যে তাদের কাছে (তাঁর মুখেই শোনা আদিবাসীদের নিজস্ব শব্দে) ‘গান ঘোরাতে’ শিখতে হয়েছে তা নয়, নানান ভাবে ‘অপমানে তাদের সমান’ হবার চেষ্টা করে ব্যর্থ ও লজ্জিত হতে হয়েছে। শ্রেণিভেদের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে, শেষ পর্যন্ত, অপারগ এমন শত শত শিক্ষকশিক্ষিকার লজ্জা থেকেই বৈষম্য-অলক্ষ্মীর পরাজয় ঘনিয়ে আসতে পারে। সমতাই সেই ‘মহাবিদ্যা’ যাকে স্তুতি করে মার্কণ্ডেয় পুরাণ বলেছেন, ‘লক্ষ্মি, লজ্জে, মহাবিদ্যে!’ সমতা সত্যের প্রথম আকার।
হয়তো ইউটিলিটির সমতা নয়, অধিকারের সমতা নয়, সুখের সমতা নয়, অর্থের সমতা নয়, আমাদের মতো কাগুজে অধ্যাপক, ‘দাঁত নেই, চোখে অক্ষম পিঁচুটি’দের আদর্শ হওয়া উচিত অপমানের সমতা। যাদের নীচে ফেলেছি, তাদের সঙ্গে অপমানে সমান হবার জন্য অনেক কিছু ছাড়তে হবে। নইলে শেষ পর্যন্ত শ্মশানে আমাদের সাম্য আসবে, যেখানে রামকুমারবাবুর গানের ভাষায় ‘অন্ধ, খঞ্জ, বধির, গলিত কুষ্ঠধারী কন্দর্পসমান রূপের দর্পকারী, রাজা আর ভিখারি সকলে সমান’। শেষ পর্যন্ত ওদের কাছে আমাদের কী ধার আছে, তা না টের পেলে আমরা এই কুশ্রী অলক্ষ্মীর অ-‘ভদ্রতা’ অ-‘কল্যাণ’ ‘অ-শিব’ থেকে মুক্তি পাব না। যে নির্লজ্জতা আমাদের বলতে শেখায় ‘নিজের মুরোদে, উচ্চশিক্ষা লাভ করে, বুদ্ধি খাটিয়ে উচ্চশ্রেণিতে উঠেছি, কারও ক্ষতি করিনি, আমার নতুন বিদেশি গাড়ির সামনে নোংরা হাত পেতে ভিক্ষে করা মানুষের আমি ধার ধারি না’, সেই নির্লজ্জতা নিয়ে ‘বাণিজ্যেতে যাবই’ মানে ‘অলক্ষ্মীরে পাবই।’ শতপথব্রাহ্মণের মতে মানুষ ঋণগ্রস্ত হয়েই জন্মায়।
পূর্ব-পশ্চিমের যে-সব বিতর্কশীল পরস্পর-বিভিন্ন-মত মুনিরা আমাদের বিচিত্র ভাষা ও চিন্তার নদীকে হাজার হাজার বছর ধরে বেগবতী রেখেছেন, সেই ঋষিমুনিদের কাছে, সমস্ত ঘামঝরা শ্রমিক-কৃষকের কাছে, মানবেতর প্রাণীদের কাছে, আমাদের আজন্ম ঋণ, পিতৃপুরুষদের কাছে ঋণের মতোই অস্বীকার করে ইদানীং আমরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে নৃশংসতার প্রতিযোগিতায় নেমেছি। লজ্জা আর হ্রী’র অভাবে আমাদের সমস্ত শ্রী বিশ্রী হয়ে পড়ছে।
ভ্যান্ গখের ‘যারা আলু খেয়ে বাঁচে’ ছবিতে এক বৃদ্ধা পার্শ্ববর্তিনী নৈশভোজসঙ্গিনীর মুখে নিজের গ্রাস তুলে দিচ্ছেন। আমার এই লেখায় যতই ফেতো সেন্টিমেন্টালিজম থাক, গায়ত্রী স্পিভাক রচিত ‘এস্থেটিক এডুকেশন’ বইটিতে আবেগ ঝরানো দরিদ্রদরদ নেই এক ফোঁটাও। ওই বই এবং রান্সিয়ের ও বঙ্কিমের সাম্য বার-বার পড়ে আমার কেবল ইচ্ছে জিজ্ঞাসা করি: ‘যারা শুধু আলুপোড়া খেয়ে বাঁচছে ভারতেরই গ্রামেগঞ্জে, তাদের কাছে ধনী আর ধনবিজ্ঞদের কতখানি ধার রয়ে গেল?’
দারিদ্রকে বাপু বলেছিলেন ‘হিংস্রতার সব থেকে খারাপ রূপ’। চারিপাশে সেই দারিদ্রের ‘অন্যায় যে সহে’, সে সাক্ষাৎ শোষক না হলেও শোষণযন্ত্রের এক জন অ-প্রতিবন্ধক সহকারী কারণ। যেমন ছিলেন ভীষ্ম দ্রৌপদীর শ্লীলতাহানির অ-প্রতিবন্ধক কারণ।
এই সব মূঢ় ম্লান মুখে ভাষা দিতে যদি বা না-ই পারি, সমাজ-ভরা বস্তি-গরম-করা হিমশীতল শপিং মল-এর অশ্লীল বৈষম্যের এই অমাবস্যায় যদি ‘সমতা’ কেন স্বাধীনতার সমান জরুরি, তা নিয়ে বিতর্কের তুবড়ি তুলতে পারা যায়, তা হলে, আশা আছে, আমাদের উৎসব লক্ষ্মীর বিবেকদীপে একটু একটু করে দীপান্বিতা হয়ে উঠবে।
|