ষাটের দশকে লম্বাচওড়া, সৌম্যকান্তি, দারুণ গ্ল্যামারাস দেখতে এক ভদ্রলোককে মোহনবাগান ড্রেসিংরুমে ঢুকতে দেখতাম। পোশাক বদলে হকি স্টিক নিয়ে নেমে পড়তেন মাঠে। রবিবার সল্টলেক সাইয়েও সেই ভদ্রলোককে দেখলাম। বেটন ফাইনালের প্রধান অতিথি। বয়স হয়েছে, শরীরের চামড়া কুঁচকেছে, পুরনো গ্ল্যামারটাও আর নেই।
ভদ্রলোকের নাম কেশব দত্ত। আর তাঁকে দিয়েই যেন বেটন কাপের এ কাল-সে কাল হুবহু তুলে ধরা যায়।
বিশ্বের প্রাচীনতম হকি টুর্নামেন্ট বেটন। একশো সতেরো বছর বয়স। আমি নিজে যখন ফুটবল খেলতাম, দেখেছি কী অসম্ভব জৌলুস জড়িয়ে থাকত এই টুর্নামেন্টটার সঙ্গে। কেশব দত্ত, লেসলি ক্লডিয়াস, গুরবক্স সিংহ, ওয়াহিদুল্লাহ-র মতো নামজাদা সব হকি প্লেয়ার, জাঁকজমকটাই আলাদা ছিল। পঁচিশ থেকে তিরিশ হাজার লোক ভিড় করত বেটন ফাইনাল দেখতে। আর এ দিন দেখলাম কর্মকর্তা-টর্তা মিলিয়েও মেরেকেটে হাজারখানেক দর্শক। গুরুবক্সকে দেখলাম, হৃদয় দিয়ে নিমন্ত্রিতদের খাতির করছে। দেখে খারাপই লাগছিল। এত চেষ্টা, এত আয়োজন, কিন্তু বেটনের সেই প্রাণটা কোথায়? কেশব দত্তকেই যেন উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে ইচ্ছে করবে। বেটনকেও যেন বার্ধক্য ছুঁয়েছে। কুঁচকে গিয়েছে শরীরের চামড়া। সেই পুরনো গ্ল্যামারটাও আর নেই।
|
এই পরিণতির দায় কিন্তু বেটনের নয়, দায় আমাদের বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গির। আগে মোহনবাগান, কাস্টমসের মতো দুর্ধর্ষ টিম খেলত বেটনে। টাটা স্টিল টিম পাঠাত। পঞ্জাব থেকে আসত উধম সিংহ, বলবীর সিংহের মতো প্লেয়াররা। উত্তরপ্রদেশ থেকে আমরা বেটনে পেয়েছি ইদ্রিস, বাবু-র মতো প্লেয়ারকে। আজ তারকা কোথায়? ওই রকম ডাকাবুকো টিম কোথায়? আয়োজন খারাপ, এ কথা কিন্তু কোনও ভাবেই বলা যাবে না। আগে ঘাসের মাঠে খেলা হত, এখন হয় অ্যাস্ট্রোটার্ফে। কিন্তু মোহনবাগানের মতো ক্লাব হকি টিমই তুলে নিয়েছে।
এক সময় মোহনবাগানের ফুটবল টিমের মতোই জনপ্রিয় ছিল হকি টিম। কাউকে দোষ দিচ্ছি না, কিন্তু কর্মকর্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গিয়েছে। ফুটবলের পাশে এখন একটা ক্রিকেট টিম করা যায়। কিন্তু হকি নয়। আর একটা বড় কারণ হচ্ছে, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান প্লেয়ারদের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া। ক্লডিয়াস, জ্যানসেনদের উত্তরসূরি কারা, কেউ বলতে পারবেন? এ দিন দেখছিলাম, মাঠে জনাকয়েক জাতীয় দলের প্লেয়ার খেলছে। কিন্তু কেশব-ক্লডিয়াসদের তারকাসুলভ ব্যাপারটা কারও মধ্যে নেই। টুর্নামেন্ট জমবে কেন? ম্যাচ ম্যাচের মতো এগোচ্ছে, আর আমরা যে যার মতো গল্প করছি। অতীতের সেই আগ্রহ, উত্তেজনা, কোনও কিছুই আর পড়ে নেই। গুরবক্সকে দেখলাম, খুব দুঃখ করছে টুর্নামেন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ধনরাজও কয়েক দিন আগে এসে বলে গেল, আর কখনও বেটনে আসবে না।
শতাব্দীপ্রাচীন বেটনকে বাঁচানোর একটাই উপায় দেখছি। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের মতো ক্লাবকে এগিয়ে আসতে হবে। নামাতে হবে হকি টিম। আসলে এই ক্লাবগুলো তুমুল জনসমর্থনের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। মোহনবাগান যদি বেটনে টিম নামায়, লোকে হকি দেখবে না বলে আমি মনে করি না। কতই বা খরচ? দশ লক্ষ টাকায় ভাল টিম হয়ে যাবে। কোটি কোটি খরচ করে ফুটবলার যখন আনা যাচ্ছে, সামান্য এই ক’টা টাকা দিয়ে বেটনকে নতুন জীবন কি দেওয়া যায় না?
|
পাঞ্জাব ন্যাশানাল ব্যাঙ্ককে ৫-২ হারিয়ে ২০১২ বেটন কাপ চ্যাম্পিয়ন হল ইন্ডিয়ান অয়েল। এই নিয়ে টানা পাঁচ বার ফাইনালে পৌঁছে চার বারই চ্যাম্পিয়ন হলেন দীপক ঠাকুররা। ইন্ডিয়ান অয়েলের হয়ে পাঁচটি গোল গুরজিন্দার, বিকাশ শর্মা, রোশন (২ গোল), এবং দীপক ঠাকুরের। পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের হয়ে দু’টি গোল করেছেন জলবিন্দর সিং ও জিতেন্দর সারোহার। |