আগে হাতের কাছেই মিলত মাটি। এখন মাটির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। নিখরচার মাটি এখন টাকা দিয়েও মেলে না।
পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রঙের দামও। আগে দু’-এক টাকা দিয়ে মা ছেলেকে বলতেন, ‘যা তো বাবা, দোকান থেকে সবুজ রঙটা কিনে নিয়ে আয়া।’ এখন ১০ টাকার নীচে রং-ই মেলেই না।
সঙ্গে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা তো আছেই। যখন তখন আকাশের মুখ ভার। হচ্ছে বৃষ্টিও। অথচ রোদ না থাকলে মাটির তৈরি জিনিস শুকোনো যায় না। বৃষ্টি হলে তো সবই মাটি। সব মিলিয়ে সঙ্কটে পড়েছেন দেওয়ালি পুতুলের শিল্পীরা।
মেদিনীপুরে দীপাবলির ঐতিহ্য দেওয়ালি পুতুল। শহরের মির্জাবাজারে কুমোরপাড়ার বহু শিল্পী বংশ পরম্পরায় এই পুতুল তৈরি করছেন। শুধু পুতুল নয়, তৈরি হয় ঘট, প্রদীপ, তুবড়ি-র মাটির খোল। সঙ্কটের সর্বত্র। এই পরিস্থিতিতে শিল্পীদের আশঙ্কা, জাত ব্যবসা ধরে রাখতে পারবেন তো? অনেকেই ইতিমধ্যেই বাপ-ঠাকুরদার এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ অন্যের দোকানে কাজ করছেন, কেউ বা ঋণ নিয়ে অটো কিনেছেন। |
মাটির কাজ ছেড়ে অটো চালাচ্ছেন গুরুপদ পাল। তিনি বলেন, “প্রথমে বাড়ির সকলের সঙ্গে মাটির কাজই করতাম। কিন্তু মাটি আনার ঝক্কি, রঙের দাম বাড়তে থাকা, সারাদিন পরিশ্রম করেও জিনিস বিক্রির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ানো। কী করে আর কাজ করি বলুন তো? তাই ঋণ নিয়ে অটো কিনেছি। চালালেই পয়সা আসে। দুশ্চিন্তা নেই।” দীর্ঘদিন মাটির কাজ করছেন অরুণ পাল। বললে, “আগে একটা প্রদীপ ৪-৫ টাকাতে বিক্রি করতাম। এখন ৭ টাকার কমে হয় না। এতদিন হাতের কাছে নিখরচায় মাটি পেতাম। এখন সেই মাটি কিনতে হচ্ছে। তা-ও আনতে হচ্ছে দূর থেকে। আমাদের মতো শিল্পীদের খুব সমস্যা।”
দেওয়ালি পুতুল তৈরিতে অভিজ্ঞ বৃদ্ধা অমলা পাল। এখন বৌমা বাসন্তী ও শিখাও কাজ শিখেছেন। তিন জনে মিলে দেওয়ালি পুতুল তৈরি করেন। কেউ রঙ করেন, কেউ চোখ আঁকেন, কেউ ছাঁচে ফেলে মুখ বানান। অমলাদেবী জানান, মাটি আনা থেকে ঝামেলা শুরু। মেদিনীপুর ছাড়িয়ে খড়্গপুরের বিভিন্ন গ্রামে মাটির খোঁজে গিয়েছিলেন। নদীর ধারের এঁটেল মাটি হলে ভাল পুতুল তৈরি করা যায়। অমলাদেবীর কথায়, “কেউ মাটি দিতে রাজি হচ্ছে না। প্রায় ২০ কিলোমিটার দুরের পাচরার কিছু লোক রাজি হওয়ায় সেখান থেকেই মাটি আনছি। তাও ১০-১২টা বড় বড় মাটির স্তূপ দেবে। তা আনতেই ২ হাজার টাকা খরচ! তাতে আবার বালি মেশাতে হয়। বালি নিয়ে আসারও খরচ রয়েছে!” বাসন্তীর কথায়, “ছেলেরা লোকের দোকানে কাজ করে। বাড়ির কাজের ফাঁকে আমরাই পুতুল তৈরি করি। সমস্যা বাড়ায়, ছেলেদের অন্য পথ দেখতে হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, জাত ব্যবসা টিকিয়ে রাখার।” পুতুলের দাম বাড়ানো যায় না? বসান্তীর জবাব, “বছর তিনকে আগেও যে পুতুল ৩-৫ টাকায় বিক্রি করতাম, তার দাম হয়েছে ৭-১০ টাকা। যেগুলোর দাম ছিল ১০-১২ টাকা, সেগুলো ২০ টাকা। এতেই ক্রেতারা জেরবার। আরও বাড়লে কেউ কিনবে?”
সঙ্কট কাটবে কীসে, সেটাও প্রশ্ন বাসন্তীদের। |