রাজ্যের দিশাহীনতা প্রকট করছে পার্থর নানা তত্ত্ব
বেসরকারি এবং যৌথ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কিন্তু জমি কেনাবেচায় সঠিক দাম না পাওয়ার অভিযোগ উঠলে সরকারের ভূমিকা কী হবে তা স্পষ্ট করেনি। এই সিদ্ধান্তহীনতাই ক্রমশ জটিল করে তুলেছে দুবরাজপুর জট। ৬ নভেম্বরের ঘটনার আগে পর্যন্ত জমির দাম সংক্রান্ত মূল সমস্যাটিকে এড়িয়ে লোবার গ্রামবাসীদের আটক করা যন্ত্র উদ্ধারেই তৎপরতা দেখিয়ে এসেছে প্রশাসন। আর এখন সংঘর্ষ নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়েও সরকারের দিশাহীন অবস্থাটা বারবার প্রকট হয়ে উঠছে।
দুবরাজপুরের ঘটনা নিয়ে কার্যত সরকারের মুখপাত্রের ভূমিকায় যিনি রয়েছেন, সেই শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুক্তি ও তথ্য খাড়া করেছেন। কিন্তু কোনও সুসংহত ব্যাখ্যা বা সমাধানসূত্র দিতে পারেননি। শিল্পমন্ত্রী কখনও বলেছেন, ৬ তারিখ পুলিশ একতরফা ভাবে অভিযান চালিয়েছে, তিনি এ ব্যাপারে কোনও নির্দেশ দেননি। কখনও অশান্তির জন্য কংগ্রেস-সিপিএম-কে দুষেছেন। কখনও মাওবাদী তত্ত্ব খাড়া করেছেন। যদিও দুবরাজপুরের কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সদস্যরা কলকাতা বিধানসভায় এসে বলে গিয়েছেন, তাঁদের আন্দোলনের পিছনে সিপিএম, কংগ্রেস, মাওবাদী কেউ নেই। শিল্পমন্ত্রী শনিবারও বলেছেন, “উগ্রবাদীরা এর পিছনে ছিল। ঝাড়খণ্ড থেকে তারা ওখানে ঢুকেছে।” তারা মাওবাদী কি না জানতে চাওয়া হলে শিল্পমন্ত্রীর জবাব, “উগ্রবাদী মানে আমি উগ্রবাদীদের কথাই বলছি। সব খবরই আছে, সময়ে প্রকাশ পাবে।” শুধু তা-ই নয়, গ্রামবাসীদের রাজি করানো থেকে জমি কেনা যাবতীয় দায় সংশ্লিষ্ট কয়লা উত্তোলক সংস্থাকেই নিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন শিল্পমন্ত্রী।
দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের (ডিভিসি) দুর্গাপুর ও মেজিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা সরবরাহ করার জন্য দুবরাজপুরের লোবা গ্রামের জমি নেওয়ার চুক্তি হয়েছিল বাম জমানায়। তার পর গত কয়েক বছরে ওই গ্রামে ৭০০ একর জমি কিনেছে ডিভিসি-র যৌথ অংশীদার বেঙ্গল এমটা গ্রুপ। অভিযোগ ওঠে, বেঙ্গল এমটার কাছ থেকে কেনা জমির দাম পাওয়া গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু ওই জমির নীচে যে খনিজ সম্পদ রয়েছে, তার মূল্য যুক্ত করা হয়নি জমির দামের সঙ্গে। আর এই দাবিতেই কৃষিজমি আগলে গত ডিসেম্বর থেকে ধর্নায় বসেছেন গ্রামের মানুষ। প্রতিবাদে খনি থেকে কয়লা তোলার ওই যন্ত্রটিও তাঁরা আটকে রেখেছেন।
শুক্রবার বিধানসভায় সেই কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সঙ্গেও বৈঠক করেন পার্থবাবু। ওই বৈঠকেও মূল সমস্যা (জমির দরবৃদ্ধি) সমাধানের ব্যাপারে কার্যত কোনও অগ্রগতিই হয়নি। শিল্পমন্ত্রী এ দিন যা বলেছেন, তা নিয়েও দু’রকম তত্ত্ব উঠে এসেছে। যেমন, এক বার তিনি বলেছেন, “ওই দাবি আবার হয় নাকি! তা হলে তো আসানসোলে কোনও দিন কয়লা তোলা যেত না। আসানসোলের বাসিন্দারা কি এখন আবার জমির বাড়তি দাম চাইবেন? জমি দিতে চেয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, সেটাই তো মেনে চলতে হবে।” পরক্ষণেই আবার বলেছেন, “জমির দাম নিয়ে সরকারের কোনও ভূমিকা নেই। সরকার তো জমি নিচ্ছে না। যাঁরা জমি নিচ্ছেন আর যাঁরা দিচ্ছেন বিষয়টি তাঁদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যাঁরা জমি কিনবেন তাঁরাই ঠিক করবেন আরও বেশি দাম দেওয়া হবে কি না।” ২০০৬ সালে লোবা গ্রামের জমির দাম নির্ধারণের সময় তৎকালীন সরকার প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছিল। শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্য স্পষ্ট, জমির বিষয়ে সরকারের কোনও ভূমিকা নেই।
জমি না হোক, গ্রামবাসীদের আটক করা যন্ত্রটি উদ্ধারে কিন্তু উদ্যোগী হয়েছিলেন খোদ শিল্পমন্ত্রী। গত জুলাইয়েই দুবরাজপুরে গিয়ে দলীয় নেতা ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন পার্থবাবু। সে দিন স্থানীয় থানার ওসি-কে ডেকে তিনি যন্ত্রটি সরানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তখনও জমির দর বৃদ্ধির দাবি নিয়ে মুখ খোলেননি। পুজোর পরে এ নিয়ে ফের শিল্পমন্ত্রীকে সক্রিয় হতে দেখা যায়। দুবরাজপুরের ঘটনার মাসখানেক আগে থেকে তিনি এবং তাঁর দফতর ওই যন্ত্রটি সরিয়ে আনতে জেলা প্রশাসনের উপর কী ভাবে চাপ সৃষ্টি করেছে, সেই তথ্য উঠে এসেছে পুলিশি তদন্তেই। পার্থবাবু এ দিন বলেন, “জুলাই মাসে আমি লোবা গ্রামে গিয়ে যন্ত্র উদ্ধারে উদ্যোগী হয়েছিলাম। রাজ্যের স্বার্থে যাতে ওখানে কয়লা উত্তোলন প্রকল্পটি হয়, তার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৬ নভেম্বরের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। সে দিন একতরফা ভাবে পুলিশ অভিযান চালিয়েছিল। কোনও আগাম অনুমতি নেওয়া হয়নি। আমি কোনও নির্দেশ দিইনি।”
পার্থবাবু যা-ই দাবি করুন, তাঁর জুলাই-যাত্রার সঙ্গে নভেম্বরের অভিযানের সম্পর্ক আছে বলে মনে করছে প্রশাসন। মহাকরণের খবর, সংশ্লিষ্ট কয়লা উত্তোলক সংস্থার প্রতিনিধি গত কয়েক মাসে বারবার মহাকরণে এসে শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ওই সংস্থা ২ কোটি টাকা দানও করেছে। তাদের অভিযোগ ছিল, জেলা পুলিশ কিছু করছে না। এখন শিল্পমন্ত্রী যদি অভিযান চালানোর নির্দেশ না দিয়ে থাকেন, তা হলে সে দিন কার নির্দেশে পুলিশ যন্ত্র-উদ্ধারে গিয়েছিল, খোলসা করে বলতে পারেননি শিল্পমন্ত্রী।
পুলিশি অভিযান নিয়ে বিতর্ক যা হওয়ার তো হয়েইছে। জমি-জট কাটবে কী ভাবে? শিল্পমন্ত্রীর সমাধানসূত্র: উত্তোলক সংস্থাকে পুনর্বাসন নীতি কার্যকর করতে হবে। পুরো পরিকল্পনা সরকারকে জানাতে হবে। কত টাকা বিনিয়োগ হবে, তা-ও জানাতে হবে। জমির প্রশ্নে গ্রামবাসীদের রাজি করিয়ে তা কিনতে হবে। খেতমজুর, বর্গাদারদের প্রাপ্য দিতে হবে। গ্রামবাসীদের জানাতে হবে পুর্নবাসন প্যাকেজ। সেই কাজ উত্তোলক সংস্থাকেই করতে হবে।
নানা মত, নানা পথ। একই সরকারের।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.