|
|
|
|
|
|
চেনা গল্প অচেনা মোচড় |
আজ কপাল পুড়ল: হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা-র
|
সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় |
রাতে মেয়রের ঘরে থাকতেই হয়েছিল, কারণ বাঁশিওয়ালা যখন এসে পৌঁছল, তখন সন্ধে হব হব। শহরে ইঁদুরের রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে। ফুটপাথে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে বুনো আর ক্ষুধার্ত মূষিকের দল। এ সব অবশ্য চেনা ছবি। পরশুরামের মতো ঘুরে-ঘুরে কম শহরে তো আর বনের ইঁদুর তাড়াল না। সবই এক রকম। ঘিনঘিনে রাস্তা, থিকথিক করছে মানুষ, গাদাগাদি করছে ইঁদুর। এর পর একটু এগোলেই দেখা যাবে নোংরা টাউন হল। সেখানে মুরুব্বিরা গজল্লা পাকাচ্ছে, চিৎকার করছে, শাপশাপান্ত করছে, কপাল চাপড়াচ্ছে, পৃথিবীতে মূষিক-যুগ শুরু হয়ে গেল বলে। তখনই বাঁশিওয়ালার প্রবেশ, আর দাবি শুনে মেয়রের চোখ গোল গোল হয়ে যাবে। ‘সঅব ইঁদুর মেরে দেবে? স-অ-ব?’ হ্যাঁ, বলবে বাঁশিওয়ালা। ‘কী ভাবে?’ জাদু-বাঁশির গল্প শুনে তার পর জামাই-আদরের ঘটা পড়ে যাবে। খেয়ে-দেয়ে বাঁশিওয়ালা বেরিয়ে পড়বে শিকারে।
কিন্তু এ বারের ব্যাপারটা অন্য। বাঁশিওয়ালা তখনই বেরিয়ে পড়ত, কিন্তু মেয়রের অফিসে আটকে দিল। বাঁশিটাকে তো যত্ন করে স্বয়ং মেয়র তুলে রাখলেন তোরঙ্গে। ইঁদুরগুলো নাকি ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছে। কেটে ফেলছে পুরনো তোরঙ্গ, কুটিকুটি করে দিচ্ছে জামাকাপড়, কবর থেকেও তুলে আনছে হাড়। এমনকী একটা লোক নাকি ইঁদুর মারতে গিয়ে উধাও হয়ে গেছে। ইঁদুরগুলো মহা ধড়িবাজ, কোথায় গর্ত করে বুবিট্র্যাপ বানিয়ে রাখবে কে জানে। রাতের দিকে ঝুঁকি না-নেওয়াই ভাল।
|
|
আসলে ওদের কথায় রাজি হওয়াই ভুল হয়েছিল। রাতে ভাল ঘুমও হয়নি। ইঁদুরগুলো রহস্যজনক ভাবে কিচমিচ করছিল ঘরময়। তোরঙ্গের উপর উঠে লাফাচ্ছিল। তখনই আন্দাজ করা উচিত ছিল। কিন্তু পর দিন সকালে নদীর ধারে আসার আগে পর্যন্ত বাঁশিওয়ালা কিছু বুঝতেই পারেনি। নদীর ধারে এসেই প্রথম সে গর্তগুলো দেখে। এমনিতে ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না, সবই ইঁদুরের গর্ত। পুরো জায়গাটা যেন ব্যাটারা চষে ফেলেছে। সেই নদীর ধার থেকে শুরু করে ব্রিজের পাশ পর্যন্ত। গর্তগুলো থেকে উঁকি মারছে নেংটি ইঁদুরের ঝাঁক। তাতেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। ইঁদুর প্রচুর, সে তো জানাই ছিল। তা না হলে লোকে বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে নাচানাচিই বা করবে কেন।
তখনই ধক করে ওর নাকে আসে পচা মতো গন্ধটা। ইঁদুরের গায়ে এ রকম পচা গন্ধ হয় নাকি? কখনও পায়নি তো। বাঁশিওয়ালা এক পা এক পা করে গর্তগুলো টপকে এগোতে থাকে নদীর দিকে। যত এগোয়, পচা গন্ধটা তত বাড়ে। সে লক্ষ করে, গর্তগুলো ক্রমশ বড় হচ্ছে। আর কিচমিচ করে বাড়ছে ইঁদুরের আওয়াজ। ও দিকে সামনাসামনি একটাকেও দেখা যাচ্ছে না। তাতে অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু নেই। মানুষকে দেখে ওরা গর্তেই লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু তা হলে আওয়াজটা আসছে কোথা থেকে? গর্তের ভিতর থেকে? ব্যাটাদের গলার এত জোর?
আরও এক পা এগোতেই কিচমিচ আওয়াজটা বাড়ে। মনে হয় পিছন থেকে আসছে। বাঁশিওয়ালা পিছন ঘুরতেই দেখে, দূরের গর্তগুলো থেকে ইঁদুরগুলো আবার উঁকি মারছে। ওর দিকে মুখ করে। বাঁশিওয়ালাই শুধু ওদের দেখছে না, ওরাও দেখছে বাঁশিওয়ালাকে। নির্ভয়ে। বাঁশিওয়ালা কস্মিনকালেও এমন মানুষ-দেখা ইঁদুর দেখেনি।
সেই সময়েই ফিরে গেলে হত। মেয়রের বাড়িতে কী ঘটেছিল, সেটাও একটু ভেবে দেখা উচিত ছিল। সেখানে তো ইঁদুরের কমতি নেই। কিন্তু ওই যে, কৌতূহল। বাঁশিওয়ালা তাই এগোতে থাকে। ইঁদুরের কিচমিচ বাড়তে থাকে। গর্তের আকার বাড়তে থাকে। সঙ্গে বাড়ে ইঁদুরের সাইজ। এক একটা পুরো বিঘতখানেক লম্বা। মানে, এক ঝলক দেখে যা বোঝা যায় আর কী। তাতেই বাঁশিওয়ালা টের পায়, নেংটির এলাকা থেকে ধাড়িদের রাজত্বে প্রবেশ করেছে। সে টপাটপ টপকে যায় ধেড়ে ইঁদুরদের বাসস্থান। ইঁদুরগুলো ওকে দেখে লজ্জায় গর্তে ঢুকে পড়ে।
চার দিকে বড় বড় গর্ত। গাছের ডাল। ঝরা পাতা। জনমানবশূন্য নদীর পাড়ের পলি। জল নেমে যাওয়ায় নদীর এ দিকের পাড়টা বেশ উঁচু। পাড় ভর্তি এই সব গর্ত চলে গেছে সিধে। একদম নদীর কাছাকাছি। তার পর একদম কাছে এসে খাড়াই ঢাল নেমে গেছে জলের দিকে। দূর থেকে সেই ঢালে কী হচ্ছে একদমই দেখা যায় না। সে জন্যই আগে থেকে ব্যাপারটা ও টের পায়নি। ঢালের ঠিক সামনে এসে তবেই সে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা দেখতে পায়। পচা গন্ধটা অবশ্য ক্রমশ বাড়ছিল। কিন্তু বাঁশিওয়ালা পাত্তা দেয়নি।
সামনে তাকিয়ে বাঁশিওয়ালা দেখে, আর কোনও গর্ত নেই। ইঁদুরের বসতি শেষ। যত দূর দেখা যায়, বালিয়াড়ি। সেই বালিয়াড়ির উপর পড়ে আছে প্রায় নগ্ন এক মানবশরীর। সেই উধাও হওয়া লোকটা। শরীর ছেয়ে আছে কালো কালো ইঁদুরে। আর তার হাতের পাশে আরাম করে বসে তিনটে ধেড়ে ইঁদুর। জামাকাপড় খেয়ে আগেই সাফ করে দিয়েছে। এখন তার হাত থেকে খুঁটে খুঁটে খুবলে মাংস খাচ্ছে।
সেই প্রথম বাঁশিওয়ালার ভয় হল। বললে বিশ্বাস হবে না, ধেড়ে ইঁদুরগুলো প্রায় বেড়ালের সাইজ। পায়ের শব্দ পেয়ে ওরা সোজা তার দিকে তাকায়। রীতিমত চোখাচোখিই হয় বলা যায়। পালানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করে না। বরং একটু দাঁত দেখায়। বাঁশিওয়ালার স্পষ্ট মনে হয়, ওরা তাকে দাঁত বার করে অভ্যর্থনা করছে। যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল।
বাঁশিওয়ালা পকেট থেকে বাঁশিটা বার করে। জোরে নিশ্বাস নিয়ে প্রাণপণে ফুঁ দেয়। উদ্ভট আওয়াজ বেরোয়। কোনও সুর বেরোয় না। অবাক হয়ে হাতে নিয়ে দেখে, ফুটোর গায়ে দাঁতের দাগ। ইঁদুরের দাঁতই হবে। কাল রাত্তিরে মেয়রের তোরঙ্গে ঢুকে চিবিয়ে সাফ করেছে।
সামনের ইঁদুরগুলো আবার দাঁত বের করে হাসে। স্পষ্টতই ওরা সবটাই জানে। নইলে হাসার কোনও কারণ নেই। বাঁশিওয়ালা পিছন ফেরে। বহু দূরে দেখা যায় ফেলে আসা রাস্তা। সেই রাস্তা আর বাঁশিওয়ালার মাঝখানে এখন হাজার হাজার ইঁদুরের গর্ত। সিল্যুয়েটের মতো দেখা যায়, সেই প্রতিটি গর্তের সামনে জড়ো হয়ে আছে রাশি রাশি ইঁদুর। নেংটি-ধেড়ে, বাদামি-কালো, সব রকম। হাজার হাজার, লাখ লাখ ইঁদুর যূথবদ্ধ হয়ে বাঁশিওয়ালার দিকে তাকিয়ে আছে। রাস্তা আর নদীর পাড়ের মাঝখানে একটা দিক ইঁদুরে কালো হয়ে গেছে, আর একটা দিক বাদামি। ওরা আর ভয় পাচ্ছে না। ওরা বাঁশিওয়ালার অপেক্ষায়।
পৃথিবীতে মূষিক-যুগ শুরু হয়ে গেছে। |
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
|
|
|
|
|
|