সিনেমা আর্টিস্ট সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের মতো দেখতে ছিল আমার সেই কাকিমাকে। খুব হুল্লোড়বাজ, আর আমার মায়ের বেস্ট ফ্রেন্ড। দু’জনে নুন শো-য় সিনেমা, গড়িয়াহাট সেল সব একসঙ্গে। বড় একটা টিপ পরে হাসিমুখে অসময়ে আমাদের বাড়ির দরজায় প্রায়শই উদয় হত। আর প্রতি বারই তার ব্যাগে থাকত নিত্যনতুন পসরা। কখনও অনেক আচারের শিশি, কখনও প্রচুর চানাচুরের প্যাকেট, কখনও হ্যান্ডিক্রাফ্ট, কখনও অন্য কী সব টুকিটাকি। নানাবিধ ব্যবসার প্রচেষ্টা। সেই ব্যবসাগুলোর কী হত? আন্দাজ করা খুব সোজা। আমাদের চেনা লোকদের যা হয় শেষমেশ কোনও ব্যবসাই দাঁড়াতে পারে না।
গল্প খুব অচেনা নয়। মফস্সলে বাড়ি। সেখানে কাকিমার বুকজল-দারিদ্র থেকে হাঁসফাঁস ওঠার চেষ্টা। সংসার যাতে কোনও মতে লক-আউট না হয়ে যায়, তার জন্যে সারা ক্ষণ দাঁত-কামড়ানো লড়াই। এ-রকম থোড়বড়িখাড়া একটি সকালে আচমকাই কাকিমার অদ্ভুত অ্যাপিয়ারেন্স। মোটেও চেনা মানুষ নয়। চোখ দু’টো একদম অচেনা, ভয়-পাওয়ানো, টিপের সাইজ আরও বড়, সাধারণ ভাবে পরা সাদা শাড়ি, চওড়া লাল পাড়। আর মাথার ঘোমটার পিছনে খোঁপাটা যেন কেমন লুকোনো, বিশাল আকৃতির। পুরনো কথাই সব বলছে, অনেকটা পুরনো ভঙ্গিতেই, কিন্তু কোথাও যেন তাল গেছে কেটে। খুব জোরে জোরে কথা, এমনিতে যেমন বলে তার চেয়ে দু’পর্দা ওপরে, কথায় কথায় বার বার মা কালীর রেফারেন্স, রাতারাতি কালীভক্তি আর তন্ত্রসাধনার জয়জয়কার। ভর, জলপড়া, তেলপড়ার মহিমাবচন, আর সবচেয়ে বেশি করে: নিজের সিদ্ধ আত্মা হয়ে ওঠার ঘোষণা।
কাকিমা চানে যাওয়ার সময় ঘোমটা খসে গেল হঠাৎ, আর আমার হৃৎস্পন্দন স্থগিত। মাথায় অত বড় সাইজের জটা দেখেও তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। এক সেকেন্ডে কাকিমা খুবই ভয়ের মানুষ হয়ে দাঁড়াল। মাথা থেকে পিঠ অবধি নেমে গেছে বটগাছের শেকড়ের মতো চার-পাঁচটা জটা, খোঁপাটা অদ্ভুতদর্শন, খানিকটা খয়েরি, খানিকটা কালো, আর সাইজটা নিতান্তই অ্যাবসার্ড।
ব্যাখ্যাটা শুনতে ঘিরে দাঁড়ালাম সব্বাই। কাকিমাও এটার জন্য অপেক্ষাই করছিল মনে হল। এক রাতেই নাকি কাকিমার সিদ্ধিপ্রাপ্তি হয়েছে। তিনি নাকি এখন সবার মা দূরদূরান্ত থেকে কাকিমার কাছে লোক আসছে, জলপড়া, তেলপড়া, মন্ত্রঃপূত ফুল নিতে। ছ্যাঁত করে উঠল বুকটা। এ কি সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’র রিপিট?
মাকে জিগেস করেও কোনও উত্তর পেলাম না। কোনও দিন আর এ বিষয়ে কোনও কথাও হয়নি। এমনধারা চলল প্রায় বছর পাঁচেক। কাকিমার প্রবল তেজ, উঠোনে ‘মা মা’ বলে চিৎকার। ভক্ত আনাগোনা, মন্দির উঠব উঠব রব। তার পর আবার এক দিন ভোরবেলায় পুরনো কাকিমার বেল। মুখটা মলিন, টিপের সাইজ ছোট, পরনে ছাপা শাড়ি। মায়ের সঙ্গে বন্ধ দরজায় মিটিং, বাইরে থেকে ফুুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ। এ বারেও মায়ের কাছ থেকে মিলল না কোনও উত্তর। বড় হয়ে বেশ বুঝেছি, এক রাতে কেন ধুনো দিয়ে এত বড় জটা, কেন ভক্তের কাছ থেকে চালটা আলুটা মুলোটা, কেন রাত জেগে হোমযজ্ঞ, কেন পোলিয়ো হওয়া ছেলের আলবাত সেরে যাওয়ার প্রমিস, কেন অবিবাহিত মেয়ের বিয়ের কবচের দাম একটু বেশি। |