|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
তবুও দুঃখ জাগে |
জরুরি এবং বিরল একটা তর্কের সুযোগ তৈরি করলেন গিরিশ
কারনাড। এবং নিজেই সেটা নষ্ট করলেন। আক্ষেপ করছেন
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় |
রবীন্দ্রনাথ না রাহুল দেববর্মন, কে বড় সুরকার? না কি, দু’জন এক সারিতে? জানার উপায় আছে কি? বড় সুরকার বলতে কী বোঝায়, কী তার মাপকাঠি, তা নিয়ে এই ধরাধামে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। ভাগ্যিস নেই। ভাবুন এক বার, এ প্রশ্নের উত্তরে বাঁয়ে ডাইনে সবাই যদি সমস্বরে বলত, ‘আমাদের রবীন্দ্রনাথ এক নম্বর’, কী ভয়ানক বোরিং ব্যাপার হত না?
উচ্চারণমাত্র খেয়াল হল, ব্যাপার তো সত্যিই বেশ বোরিং। বঙ্গসমাজে এ প্রশ্ন নিক্ষেপ করলে সর্বজনসম্মতিই মিলবে না কি? কারও মনে অন্য উত্তর যদি থাকেও বা, যদি কেউ এক মনে তাঁর একতারাতে একটি যে সুর সেইটি না বাজিয়ে আর ডি’র সহস্রধারা সুরের বৈচিত্রকে গুরুদেবের ওপরে স্থান দিতে চান, বাঙালির হাটে সে কথা মুখ ফুটে বলবেন? বলতে পারবেন?
গিরিশ কারনাড মহাশয়ের রবীন্দ্র-বিদূষণ এবং তার জবাবে নানা জনের নানা মন্তব্য শুনে ও পড়ে কথাগুলো মনে এল। রাহুল দেববর্মনের নামটা নেহাতই উদাহরণ। তবে কবুল করি, এই উদাহরণটাই পেশ করার পিছনে একটা মতলব আছে। কম বয়েসে জানতাম, রাহুল দেববর্মন ভাল নয় শচীনকত্তার জবাব নেই, কিন্তু ছেলেটা একেবারে লারেলাপ্পা হয়ে গেল। আর, রবীন্দ্রনাথ? ঠাকুর। জীবনধারার ছাপ চেতনাকে গড়ে, আর ডি’র মহিমা চিনতে বেলা গড়িয়েছে। তাই ঝোপ বুঝে একটু ব্যক্তিগত প্রায়শ্চিত্ত করে নেওয়া গেল আর কী!
কিন্তু ব্যক্তি উপলক্ষমাত্র। সে ব্যক্তি রাহুল দেববর্মনই হোন, গিরিশ কারনাডই হোন, বা রবীন্দ্রনাথ। আসল প্রশ্ন হল, যাঁরা খুব বড় মাপের মানুষ, যাঁদের অনেক গুণ, অনেক সৃষ্টি, অনেক কীর্তি, যাঁরা বহু কাল বহু মানুষের কাছে সম্মানিত, তাঁদের প্রতিভা ও সৃষ্টির গুণমান সম্পর্কে বিরূপ সমালোচনা করা যাবে কি না, তাঁদের কাজের সঙ্গে অন্যের কাজের তুলনা করা যাবে কি না, এবং করলে কী ভাবে করা যাবে। গিরিশ কারনাড যে ভাবে রবীন্দ্রনাথের নাটকের নিন্দা করেছেন, সেটা অবশ্যই ঠিকঠাক নয়। অশোভন, দাম্ভিক, অন্যায় বহু বিশেষণেই তাঁর আচরণকে বিশেষিত করা হয়েছে, সমার্থশব্দকোষে আরও অনেক প্রতিশব্দ পাওয়া যেত, এবং কোনওটিই সম্পূর্ণ অযৌক্তিক হত না। |
|
নাট্যকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গিরিশ কারনাড। |
কিন্তু সেটা গৌণ প্রশ্ন। গিরিশ কারনাডের প্রধান অন্যায় এই যে, তাঁর সমালোচনা পরিশ্রমহীন, অলস। তিনি যদি রবীন্দ্রনাথকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাট্যকার বলেন, তবে তাঁকে স্পষ্ট করে, যুক্তি দিয়ে বলতে হবে, ঠিক কী কী কারণে সেটা বলছেন। নিজে খুব বড় মাপের নাট্যকার এবং নাট্যতত্ত্ববিদ বলেই তাঁর তথ্য ও যুক্তি দেওয়ার দায়িত্ব অনেক গুণ বেশি। তিনি দায়িত্ব পালন করেননি। নিজের প্রতি, নিজের বিদ্যার প্রতি অবিচার করেছেন।
একটু ভুল হল। আত্মপক্ষ সমর্থনে গিরিশ কারনাড দু’একটি যুক্তি দিয়েছেন। যেমন, রবীন্দ্রনাথ গরিব মানুষকে চিনতেন না, তাই তাঁর নাটকে গরিব মানুষদের বানানো, অর্থাৎ কৃত্রিম, অস্বাভাবিক এবং অবাস্তব চরিত্র বলে মনে হয়। এই অভিযোগ এক কথায় উড়িয়ে দিলে সম্ভবত ভাবের ঘরে চুরি করা হবে। কেবল নাটক নয়, রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস, আখ্যান-কবিতা ইত্যাদি পড়তে গিয়েও অনেক সময়েই খটকা লাগে, সবাই কেমন যেন রবীন্দ্রনাথের ভাষাতেই কথা বলছে না? আমরা এই খটকাটুকুর কথাই বলতে পারি। এর বেশি বিচার করার জন্য বিশেষজ্ঞরা আছেন, তাঁরা বলবেন। আর এখানেই গিরিশ কারনাডদের নৈতিক দায়। তাঁরা বিশেষজ্ঞ, তাঁদের শুধু মন্তব্য করে দিলেই চলে না, ব্যাখ্যা করতে হয়, সে জন্য পরিশ্রম করতে হয়।
গিরিশ কারনাডের দ্বিতীয় যুক্তি, দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথের নাটক দেশদুনিয়ায় বিশেষ অভিনীত হয়নি, তাঁর সমকালের বাংলা মঞ্চেও খুব একটা নয়। এটা কোনও বিচারের প্রশ্ন নয়, তথ্যের প্রশ্ন, যাকে বলে ‘কোয়েশ্চেন অব ফ্যাক্ট’। এ ধরনের প্রশ্নের সত্যাসত্য যাচাই এক অর্থে সহজ তথ্য যাচাই করে নিলেই হল। মুশকিল হল, গিরিশ কারনাড এমন আলগা এবং অস্পষ্ট ভাবে কথাটা বলেছেন, যার ফলে সেই যাচাইয়ের কাজটা কঠিন। রবীন্দ্রনাথের কোন নাটক দেশে ও বিদেশে কতটা মঞ্চায়িত হয়েছে, সেই সব প্রযোজনা কতটা জনপ্রিয় হয়েছে, জনপ্রিয়তার মাপকাঠি ছাড়া অন্য মাপকাঠিতেই বা কতটা উত্তীর্ণ হয়েছে, এই সব প্রশ্নের সম্যক আলোচনা না করে একটা মন্তব্য ছুড়ে দিলে সেটা মন্তব্যই থেকে যায়। অথচ, ঠিক ভাবে বিচার করলে হয়তো দেখা যাবে, তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা মোটেই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। অন্তত তাঁর কথার প্রতিবাদে এবং রবীন্দ্রনাথের নাটকের মহত্ত্ব প্রমাণ করতে যে ধরনের তথ্য ও যুক্তি পরিবেশন করা হচ্ছে, সেগুলি খতিয়ে দেখলে তেমন সংশয়ই হয়। বিশেষজ্ঞরা যদি সেই সংশয় নিরসন করেন, অপেক্ষায় থাকব।
দুঃখ একটাই। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন তোলার এমন চমৎকার সুযোগ তৈরি করে গিরিশ কারনাড নিজেই সেটি নষ্ট করে দিলেন। ‘তিনি এক জন মহান কবি, কিন্তু এক জন মাঝারি মানের এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাট্যকার’, এই প্রতিপাদ্যটি নিয়ে এক অতি সমৃদ্ধ বিতর্ক গড়ে উঠতে পারত, আমরা সেই বিতর্ক শুনে এবং পড়ে ঋদ্ধ হতাম। জানতে পারতাম, নাট্যকার হিসাবে দেশে ও দুনিয়ায় রবীন্দ্রনাথ কোথায় আছেন, কেমন আছেন। যদি মেনে নিতে হত, তাঁর নাটক প্রথম সারিতে নেই, ‘সত্যেরে লও সহজে’ বলে মেনে নিতাম। নেব না-ই বা কেন? রবীন্দ্রনাথের নাটক তো আর রবীন্দ্রনাথ নয়। ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথের সুরও রবীন্দ্রনাথ নয়। এ সবই তো তাঁর প্রতিভার বিভিন্ন দিকের প্রকাশ। নিজের প্রতিভাকে তিনি বহু ধারায় প্রবাহিত করিয়েছেন। সব ধারাতেই তিনি সতত সমান সফল, সেই সেই ধারায় তিনিই প্রথম সারিতে, এমনটা ধরে নেওয়ার তো কোনও কারণ নেই। অথচ আমরা তাঁর কাছে দাবি করি, তাঁকে সব সাবজেক্টে ফার্স্ট হতে হবে। যাঁরা তাঁকে ‘ইন্টারপ্রিট’ করতে বসেন, তাঁরাও শেষ পর্যন্ত তর্পণেই ক্ষান্ত হন। গিরিশ কারনাড যদি-বা বিবাদী স্বর তুললেন, পরিশ্রম করলেন না, উল্টে আলটপকা নানা মন্তব্য করে আমাদের গুরুবাদেই ধুনোর গন্ধ দিলেন।
কে বড় সুরকার, রাহুল দেববর্মন না রবীন্দ্রনাথ, সেটাও বোধ করি কোনও দিনই জানা হবে না। |
|
|
|
|
|