স্থানীয় হাটে সব্জি বিক্রি করে সাইকেলে বনগাঁ-চাকদহ সড়ক ধরে বাড়ি ফিরছিলেন সুন্দরপুর গ্রামের ছোবাহান মন্ডল (৪৫)। পিছন থেকে প্রচণ্ড জোরে ছুটে আসা মোটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারে তাঁকে। ছিটকে পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান ছোবাহান।
বনগাঁর শিমুলতলার বাসিন্দা গোপাল ঘোষ মোটর সাইকেলে গোপালনগরের দিকে যাচ্ছিলেন। একটি মিনি ট্রাককে ওভারটেক করতে গেলে সেটি পিছনে সজোরে ধাক্কা মারে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় গোপালবাবুর।
এগুলি কোনও বিছিন্ন ঘটনা নয়। বনগাঁ-চাকদহ সড়কের বর্তমানে যে অবস্থা তাতে তা কার্যত মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। ছোট-বড় দুর্ঘটনা রোজকার ঘটনা। পরিস্থিতি এমনই যে, ইষ্টনাম জপতে জপতে যাতায়াত করেন যাত্রীরা। বাড়ি থেকে বের হলে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় থাকেন পরিবারের লোকজন।
বনগাঁর মিলিটারি রোডের মুখ থেকে নদিয়ার চাকদহের চৌমাথা পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩২ কিলোমিটার। কয়েক বছর আগে রাস্তার অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। রাস্তা সংস্কারের দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন এলাকার মানুষ। |
পূরণ হয় দাবি। এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্কের (এডিবি) ঋণের টাকায় এবং পশ্চিমবঙ্গ করিডর উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে রাস্তা সারায় রাজ্য পূর্ত দফতর। বেহাল রাস্তা ভোল বদলে পরিণত হয় ঝাঁ চকচকে রাজ্য সড়কে। বছর দুয়েক আগে শেষ হয় সংস্কারের কাজ। কিন্তু ঝাঁ চকচকে রাস্তাই এখন রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এলাকাবাসীর। মসৃণ রাস্তায় যানবাহনের প্রচণ্ড গতিতে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পথ দুর্ঘটনা। পুলিশ প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এগারো মাসে এই সড়কে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ২০ ছাড়িয়েছে। জখমের সংখ্যা তার দ্বিগুণ। কিন্তু দুর্ঘটনা উত্তরোত্তর বাড়তে থাকলেও এই রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রণে পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় বাসিন্দাদের। যদিও পুলিশ-প্রশাসনের উপরেই যাবতীয় দোষ চাপাতে নারাজ এলাকাবাসী। আর তার কারণ, পুলিশ ও বাসিন্দাদের মতে সড়কের উপর যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, দ্রুতগতিতে ওভারটেক, যত্রতত্র হঠাৎ গাড়ির গতিপথ পরিবর্তন এর অন্যতম কারণ। এ ছাড়া পথচারীদের অসর্তকতা তো রয়েছেই। সড়কের দু’ধারেই ইমারতির জিনিসপত্র ডাঁই করে রাখা ও ট্রাক দাঁড় করিয়ে রাখার ফলে যান চলাচলের অংশ খুবই সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে অধিকাংশ গাড়ির চালকই ঠিকমতো রাস্তা দেখতে পান না। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা।
প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে যথাসাধ্য চেষ্টা হচ্ছে। গোপালনগর থানার তরফে পথচারী ও যানচালকদের প্রতি আবেদন জানিয়ে লিফলেট ও মাইকে প্রচার করা হচ্ছে। চালকি ও কালীবাড়ি মোড়ে গার্ড রেল বসানো হয়েছে। কালীবাড়ি মোড়ে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ করে যান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হয়েছে। জনবহুল এলাকায় কম গতিতে গাড়ি চালাতে এবং ওভারটেক ও যত্রতত্র পার্কিং বন্ধ রাখতে আবেদন জানানো হয়েছে। পরিযান আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এ সব ব্যবস্থা সত্ত্বেও পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু কমেনি। পুলিশ সূত্রের খবর, রাস্তা সারানোর ফলে যানবাহনের গতি অস্বাভাবিক বেড়েছে। বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালানোর ফলে রাস্তার বাঁকগুলোতে অনেক চালকই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটছে। এই অবস্থায় বাসিন্দাদের দাবি, স্পিডব্রেকার বসিয়ে যানের গতি নিয়ন্ত্রণ করা হোক। যদিও পুলিশের বক্তব্য, এ ভাবে রাজ্য সড়কে যান নিয়ন্ত্রণ নিয়মবিরুদ্ধ।
বনগাঁ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সৌমেন দত্ত বলেন, ‘‘এই সড়কে যান চলাচলের গতি ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। তাই স্পিডব্রেকার বসানো সম্ভব নয়। নির্দিষ্ট মোড়ে ট্রাফিক দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সর্বত্র তা সম্ভব নয়।’’ বনগাঁর মহকুমাশাসক অভিজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “গোটা বিষয়টি নিয়ে এসডিপিও-র সাথে কথা বলব।’’ বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাসের কথায়, ‘‘পঞ্চায়েত এবং প্রশাসনের মাধ্যমে পথচারীদের সচেতনতা বাড়াতে পদক্ষেপ করা হবে।’’
তবে যে পদক্ষেপই করা হোক না কেন, সড়ক নিয়ে স্বস্তি চান স্থানীয় মানুষ। |