ভবানন্দ থেকে মছলিবাবা। সাধুর ভেক ধরে দুষ্কর্ম করে কেউ রেহাই পায়নি ডাক্তার হাজরা এবং ফেলুদার হাত থেকে।
এ বার ফালাকাটা থেকে ধরা পড়ল প্রভাস ঢালি। কুখ্যাত সমাজবিরোধী প্রভাসের তখন পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবী। সাদা ধুতি। গায়ে উত্তরীয় জড়ানো। কপালে তিলক। গলায় তুলসীর মালা। মুখে হরিনাম। সংকীর্তনে বিভোর হয়ে রয়েছেন। নাম, ‘মহারাজ।’ তাঁর গান শুনে অঝোরে কেঁদে চলেছেন মানুষ। ঠিক যেন বারাণসীতে মছলিবাবার আসর। সামনে শহরের গুণীজ্ঞানী জন। মছলিবাবার কথা শুনে যাঁরা মুগ্ধ। তাঁরা ভাবতেই পারেননি এই মছলিবাবার সঙ্গেই সম্পর্ক রয়েছে মগনলাল মেঘরাজের।
গ্রামের মানুষও বুঝতে পারেননি, তাঁদের ‘কীর্তনীয়া’ই রাস্তায় দিনেদুপুরে খুন করেছে। প্রয়োজনে কোলের শিশুকেও খুন করতে তার হাত কাঁপে না। মাস সাতেক আগে বারাসতের কাহারপাড়ায় তৃণমূল নেতা বিনয় বিশ্বাস-সহ তাঁর বৃদ্ধ মা-বাবাকে খুন করে প্রভাস। তারপর সে কীর্তনের দল খুলে পালিয়ে গিয়েছিল। মঙ্গলবার ফালাকাটায় সে কীর্তনের আসর বসাবে খবর পেয়ে আগে থেকে গ্রামবাসী সেজে সেখানে হাজির হন স্থানীয় পুলিশকর্মীরা। তাঁরাই জয়বাবা ফেলুনাথে মছলিবাবার পোশাকে মগনলাল মেঘরাজকে যেমন ধরেছিল ফেলুদা, তেমনই কীর্তনের আসরে উঠে ধরে ফেলে প্রভাসকে। পার্থক্য এটাই। ফালাকাটার আসরে প্রভাস ছিল মধ্যমণি কীর্তনীয়া। আর ছদ্মবেশে পুলিশ ছিল দর্শকাসনে।
অপরাধ ঢাকা দিতে সমাজবিরোধীদের এ ভাবে সাধু ভেক নেওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এরআগে হাবরারা কুখ্যাত অপরাধী সুরেশও পুলিশের ভয়ে সাধুর ভেক নিয়ে গা ঢাকা দেয়। পরে অবশ্য সে খুন হয়ে যায়। পুলিশ কর্তাদের বক্তব্য, ধর্মকে আঁকড়ে প্রভাস-সুরেশদের মতো সাধু ভেক ধরার ঘটনা নতুন নয়। কেননা, সেক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ভাবাবেগ তাঁদের আশ্রয় হয়ে যায়। সেই ভাবাবেগেই মানুষ মনে করে, এই ব্যক্তি কোনও ভুল করতে পারে না। সেক্ষেত্রে পুলিশেরও কাজ কঠিন হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তাদের প্রিয় কীর্তনীয়াকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে আসরে প্রতিবাদ হয়। তবে পরে অবশ্য পুলিশ তাঁদের বুঝিয়ে নিরস্ত করতে পেরেছে।
কিন্তু কী ভাবে অপরাধ জগতে হাতেখড়ি হল প্রভাসের? বছর পঁয়তাল্লিশের প্রভাসের বাড়ি বনগাঁ মহকুমার গাইঘাটার মানিকহীরা গ্রামে। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সাইকেল চুরি দিয়ে অপরাধ জগতে ‘হাতেখড়ি’ তার। চালাক-চতুর যুবকটি বুঝে নিয়েছিল, এ ভাবে বেশি দূর ‘এগোনো’ যাবে না। সঙ্গীসাথীর অভাব হয়নি। প্রভাস দ্রুত ভিড়ে যায় সুটিয়া-গণধর্ষণ কাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত সুশান্ত চৌধুরী নামে এক কুখ্যাত দুষ্কৃতীর দলে। ডাকাতির ঘটনায় মালের বখরা নিয়ে দু’জনের বিবাদ বাধে অচিরেই। ভেঙে যায় ‘জুটি।’ এ বার নিজেই দলবল গড়ে ফেলে প্রভাস।
গাইঘাটাকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠে প্রভাসের ‘সাম্রাজ্য’। লোকে সে সময়ে তাকে ডাকত ‘মহারাজ’ বলে। ২০০০ সাল নাগাদ নদিয়ার গাংনাপুর থেকে শুরু করে বনগাঁ, চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগরে প্রভাসের ভয়ে কার্যত ‘বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত।’ তোলাবাজি, খুন-জখমের অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়ে চললেও পুলিশের কাছে বেশির ভাগ সময়েই তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেতেন না মানুষ।
শুধু উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন থানাতেই তার নামে গোটা দশেক খুনের অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্তারা। প্রভাসের তোলাবাজি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, গ্রামে বিয়ে বা অন্য কোনও অনুষ্ঠান হলেও তাকে ‘নজরানা’ দিতে হত। গাইঘাটার ডুমা বাওরে বড়সড় বজরা ভাসিয়ে বেশির ভাগ সময় ঘুরে বেড়াত প্রভাস। এলাকার লোক বলত ‘জাহাজবাড়ি।’ গ্রামের নানা জায়গায় সশস্ত্র লোক সারা ক্ষণ থাকত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। তাদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ‘মাছিটুকুও’ গ্রামে ঢোকার সাহস পেত না বলে জানালেন এলাকার মানুষজন।
মানিকহীরার বাসিন্দা গোপাল মাঝিকে খুনের দায়ে ২০০২ সালের জুনে জেল হয় প্রভাসের। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সে ছাড়া পেয়েই এলাকায় ‘প্রভাব’ বাড়াতে উঠে পড়ে লাগে। মানিকহীরায় তার এক স্ত্রী, ছেলে আছে। জেল থেকে বেরিয়ে ফের বিয়ে করে প্রভাস। মাস চারেকের মধ্যেই বনগাঁ মহকুমা আদালত চত্বর থেকে গুলি-ভর্তি পাইপগান-সহ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ওই মামলায় ক’দিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যায় কুখ্যাত এই দুষ্কৃতী।
এর পর থেকেই গাইঘাটার পাশাপাশি আরও কিছু জায়গায় আস্তানা গাড়ে প্রভাস। বিরাটি, বাগুইআটি ছাড়াও বারাসতের কেমিয়া খামারপাড়া পঞ্চায়েতের নওপাড়াতেও ডেরা গাড়ে। কেমিয়া খামারপাড়ায় সম্প্রতি জমি কেনাবেচার যে হিড়িক পড়েছে, তাতেও দ্রুত জড়িয়ে পড়ে প্রভাস। তা নিয়ে গণ্ডগোলের জেরেই সে খুন করে বিনয় বিশ্বাস ও তাঁর পরিবারকে। পুলিশের একাংশ এবং স্থানীয় মানুষ জানাচ্ছেন, এক সময়ে সিপিএমের ‘ছত্রচ্ছায়ায়’ থাকা প্রভাসের ইদানীং ‘ঘনিষ্ঠতা’ বেড়েছিল তৃণমূলের সঙ্গে। যথারীতি সেই ‘দায়’ নিতে চাননি দু’পক্ষের কোনও নেতাই।
কিন্তু এই অঞ্চলে মানুষ তাকে প্রকাশ্যে দেখত অন্য ভূমিকায়, অন্য পোশাকে। কয়েক জন সঙ্গীসাথী জুটিয়ে নামগানের দল গড়ে ফেলেছিল প্রভাস। বারাসতে সে ‘পরিচিতি’ পায় ‘পুরোহিত’ নামে। গ্রামের মানুষ জানালেন, ব্যবহার খুবই ভাল। আর গানের গলাটি তো বড় মিষ্টি! আর সেই ‘গুণাবলিতে’তেই এক দিকে, হরিনাম ও অন্য দিকে অপরাধ দুই এক সঙ্গে সামলাচ্ছিল প্রভাস।
যিনি ‘মহারাজ’, তিনিই আসলে সেই প্রভাস। |