শ্রীলঙ্কার প্রধান বিচারপতি শিরানি বন্দরনায়েকে ইম্পিচমেন্ট-এর সম্মুখীন। তিনি দেশের প্রথম মহিলা প্রধান বিচারপতি। গত বছর প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষ দেশের পুলিশ প্রধান, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা সাংবিধানিক ভাবে নিজের হাতে তুলে নেবার পর শিরানিকে সুপ্রিম কোর্টের শীর্ষ পদে নিয়োগ করেন। রাজাপক্ষকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা বুঝবেন, সে সময় উভয়ের সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা, আনুগত্য ও পারস্পরিক আস্থা ছিল। কিন্তু এই মধুচন্দ্রিমা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিচারবিভাগের সাংবিধানিক স্বাতন্ত্র্য মেনে নিতে অসম্মত রাজাপক্ষ সরকার ক্রমাগত দেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগের ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেও তাঁকে অপসারণের ক্ষমতা কেবল পার্লামেন্টেরই আছে। তাতে কোনও অসুবিধা হয়নি। প্রধান বিচারপতির আচরণ ‘জনসাধারণের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করছে’ এই অস্পষ্ট অভিযোগ এনে তাঁকে ইম্পিচ করতে অর্থাৎ রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করতে এগিয়ে এসেছে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষর তাঁবে পার্লামেন্ট, যার স্পিকারও আর এক রাজাপক্ষপ্রেসিডেন্ট মহিন্দার নিজের দাদা।
শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষ পরিবারের সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে এটা আর একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যার লক্ষ ছিল বিচারবিভাগকে সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া। বার্তাটি আর কিছু নয় আইনের শাসনের চেয়ে রাজাপক্ষ বড় এবং বিচারব্যবস্থাকে তাঁর একনায়কত্বের অধীন থাকতে হবে, তাকে কোনও মতেই অস্বস্তিতে ফেলা চলবে না। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে রাজাপক্ষের সরকার বেশ বিপাকে পড়ে যায়। সরকারের আনা একটি বিলে বিভিন্ন প্রদেশকে বণ্টন করে দেওয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনৈতিক তহবিল কেড়ে নিয়ে নতুন করে তা রাজাপক্ষের হাতে অন্তরিত করার প্রস্তাব ছিল। শিরানি বন্দরনায়েকের অধীন সুপ্রিম কোর্ট এই বিলে অনুমোদন দিতে অস্বীকার করে। সুপ্রিম কোর্টের বক্তব্য ছিল এই বিল সংবিধানসম্মত নয়। উল্লেখ্য, নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকারগুলির হাতে শাসনক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত করার এই বন্দোবস্তটি ছিল শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী, যা ১৯৮৭ সালের ভারত-শ্রীলঙ্কা চুক্তির অন্যতম অনুচ্ছেদ ছিল। কিন্তু রাজাপক্ষের একনায়কত্ব আর ক্ষমতার এই বিকেন্দ্রীকরণের গণতান্ত্রিকতা মেনে নিতে পারছে না। সে জন্যই ওই সংশোধনী বিল। |
প্রেসিডেন্ট মহিন্দা রাজাপক্ষ। |
প্রধান বিচারপতি শিরানি বন্দরনায়েকে সরকারের পরামর্শ উপেক্ষা করে মঞ্জুল তিলকরত্নেকে বিচারবিভাগীয় সার্ভিস কমিশনের সচিব নিযুক্ত করেছিলেন। তাতেও রাজাপক্ষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক চিড় খায়। মঞ্জুলকে অজ্ঞাত আততায়ীরা ছুরিকাঘাতে হত্যার চেষ্টাও করে। বস্তুত তামিল গেরিলাদের সঙ্গে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের অবসানের তিন বছর পরে দেখা যাচ্ছে, রাজাপক্ষের একনায়কত্বের প্রাক্তন সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব ঘুচে যাচ্ছে। দু’ বছর আগে এলটিটিই ধ্বংসের অভিযানের নায়ক সেনা-প্রধান শরৎ ফনসেকার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের ভাই প্রতিরক্ষামন্ত্রী গোটাবায়া রাজাপক্ষের মতবিরোধ বাধে সাফল্যের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে। বিরোধ এতই অমীমাংসেয় হয়ে ওঠে যে, সেনাপ্রধান ইস্তফা দিতে বাধ্য হন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার স্পর্ধা দেখানোয় তাঁকে জেলেও যেতে হয়। তাঁর ‘অপরাধ’ প্রমাণে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে প্রবীণ সাংবাদিক, সেই ফ্রেডিরক জান্সকেও সম্প্রতি ‘সানডে লিডার’ সংবাদপত্রের সম্পাদক পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। যে ভাবে গত তিন বছর ধরে সরকার-সমালোচক বহু বিশিষ্ট সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, নাগরিক ও মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ‘তামিল গেরিলা সমর্থক’ আখ্যা দিয়ে অপহরণ করা হয়েছে, নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ করে দেওয়া হয়েছে, তাতে রাজাপক্ষের গণতন্ত্র অনায়াসেই লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ানের ‘কদলী প্রজাতন্ত্র’গুলির সঙ্গে একাসনে বসতে পারে। চিলি, আর্জেন্তিনা, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, পেরু, নিকারাগুয়ায় একনায়কের হাতে স্বৈরশাসন ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার প্রক্রিয়ায় এ ভাবেই গণমাধ্যম, বিচারবিভাগ, গণতান্ত্রিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ঐতিহ্য ধ্বংস করে দেওয়ার নজির ভূরি-ভূরি। খুড়তুতো-মামাতো-পিসতুতো মিলিয়ে রাজাপক্ষ পরিবারের লোকরাই আজ শ্রীলঙ্কার সরকার, প্রশাসন, সমাজের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। পারিবারিক একনায়কতন্ত্রের যাবতীয় পথের-বাধা দূর করতেই শ্রীলঙ্কায় আজ সংবিধান সংশোধন হয়, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির ইম্পিচমেন্ট হয়, পথ-দুর্ঘটনায় কিংবা আততায়ীর হামলায় বিবেকবান ও আপসহীন গণতন্ত্রীরা নিহত হন আর চাটুকাররা মন্ত্রী হয়।
শিরানি বন্দরনায়েকের ইম্পিচমেন্ট অতএব মসৃণ ভাবেই অগ্রসর হবে। ব্যাপক কারচুপি, ভীতি-প্রদর্শন ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে জাতীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে যে দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা রাজাপক্ষরা হাসিল করেছেন, ইতিপূর্বেই ভেনেজুয়েলার ‘আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট’ উগো চাভেসের অনুকরণে সেই বশংবদ পার্লামেন্টকে দিয়ে মহিন্দা নিজের ক্ষমতার মেয়াদ অনন্ত করে নিয়েছেন। ‘মহাবংশ’ ঘরানার যে সংকীর্ণ থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম সিংহলি উগ্র জাতীয়তাবাদ উস্কে সংখ্যালঘু তামিলদের নিশ্চিহ্ন করার প্রবক্তা, তার ঢালাও আশীর্বাদ পেতেও রাজাপক্ষর অসুবিধা হয়নি। আন্তর্জাতিক বিশ্বে রাশিয়া ও চিনের মতো দুই বহুত্ববাদ-দলনকারী স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের প্রবল সমর্থন রাজাপক্ষ-শাসিত দ্বীপরাষ্ট্রের কূটনৈতিক নিঃসঙ্গতাও দূর করেছে। আর নিজের খিড়কি-উঠোনের এই দ্বীপভূমিকে চিন-রাশিয়ার কোলে ঢলে পড়তে না-দেবার ‘রণনৈতিক তাগিদ’ থেকে নয়াদিল্লিও রাজাপক্ষের যাবতীয় অনাচারের দিকে চোখ বুজে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তামিলদের বধ্যভূমি শ্রীলঙ্কা তাই দ্রুত গণতন্ত্রের শ্মশানশয্যাও হয়ে উঠছে। |