প্রবন্ধ ১...
ভারতের উল্লাসের কোনও কারণ নেই

৭০টি ভোট পেলে যেখানে জয়, সেখানে প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামার প্রাপ্তি ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। অথচ, তাঁর দ্বিতীয় বার জয়ের পথটি আগাগোড়া তত মসৃণ ছিল না। স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প রূপায়ণে বাধা তো ছিলই, রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে মার্কিন অর্থনীতির সংকট-মুক্তির চেষ্টাও বাধার সম্মুখীন হয়েছে। সর্বশেষ ছিল ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির ভয়ংকর আঘাত। কিন্তু সব বাধা কাটিয়েই তিনি পুনরায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি। পুনরায় পৃথিবীর ‘সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী’ ব্যক্তি!
হোয়াইট হাউসে দ্বিতীয় বার নিজের আসনটিকে সুনিশ্চিত করার পরে ভোটদাতা এবং সমর্থকদের ধন্যবাদ দিতে গিয়ে ওবামা একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, মার্কিন সমাজের যে বৈচিত্র সেটাই আমেরিকার সম্পদ। উল্লেখ্য, ইদানীং মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দা বিষয়ক আলোচনায়, বিতর্কে প্রায়ই অভিবাসী মানুষদের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ওবামার প্রতিপক্ষের কণ্ঠেও শোনা গেছে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কড়া হুমকি। তাই বিভিন্ন প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষা বা নির্বাচনোত্তর পর্যালোচনায় যখন বলা হয় যে, আফ্রিকান-আমেরিকান কিংবা লাতিন বংশোদ্ভূত নির্বাচকদের বড় অংশই, মিট রোমনি নয়, ওবামার প্রতিই তাঁদের সমর্থন জানিয়েছেন, তখন তা অবিশ্বাস করার কারণ থাকে না।
একই ভাবে উঠেছে আমেরিকা থেকে বিভিন্ন কাজ দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার (আউটসোর্সিং) প্রসঙ্গও। বিশেষ করে বহু মার্কিন সংস্থাই সস্তায় উৎপাদন ও পরিষেবা দিতে গিয়ে, কম খরচে কাজ করিয়ে নিতে গিয়ে নানা কাজ এশিয়াতে, মূলত চিন ও ভারতে চালান করেছে। ‘মন্দাক্রান্ত’ আমেরিকার নাগরিক স্বাভাবিক ভাবেই এতে ক্ষুব্ধ। যেখানে দেশের মানুষের রোজগারে টান পড়েছে, সেখানে বিদেশে কাজ পাঠানো কেন? ওবামাও এই আউটসোর্সিং নিয়ে অতীতে যথেষ্ট কঠোর মন্তব্য করেছেন। তা সত্ত্বেও হয়তো রিপাবলিকান রোমনি-র চাইতে এই বিষয়ে ওবামা কিছুটা নরমপন্থী।
তবে এ বারে নির্বাচনী প্রচারের অন্তিম পর্বে যে-ভাবে ‘স্যান্ডি’ আমেরিকার পূর্বাংশে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তাতে ওবামাকে হয়তো না-রাখা কথায় ফিরতে হতে পারে। সেই না-রাখা কথা জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে। কথা ছিল, বিকল্প শক্তির ক্ষেত্রে আমেরিকা পদক্ষেপ করবে। তেমন প্রয়াস ওবামা প্রশাসনের প্রথম পর্বে আদৌ দেখা যায়নি। এই বারের ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলার পিছনে অনেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রভাব দেখতে পাচ্ছেন। আর আমেরিকা এই নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করলে তার প্রভাব ভারতের উপরেও পড়বে।
সাম্প্রতিক কালে সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে ভারত ও আমেরিকা যথেষ্ট কাছাকাছি এসেছে। পাক-আফগান সীমান্তে ধারাবাহিক মার্কিন অভিযান পরোক্ষে ভারতে সীমান্ত-পারের সন্ত্রাসী হানায় কিছুটা ছেদ ঘটিয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখনও সংকটাপন্ন। আমেরিকা তথা নেটো বাহিনী ক্রমান্বয়ে প্রত্যাহৃত হলে সেই দেশের হাল কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে গভীর সংশয় থাকছেই। কিছু পাক সেনাকর্তা এবং গোয়েন্দাকর্তার ঘনিষ্ঠ তালিবানপন্থীদের প্রভাব থেকে আফগানিস্তান এখনও মোটেই মুক্ত নয়। রাজধানী কাবুলেও তালিবান জঙ্গিদের হানাদারি অব্যাহত। ওয়াশিংটনের প্রচ্ছন্ন ও প্রত্যক্ষ সমর্থনের ফলে নয়াদিল্লি আফগানিস্তানে বেশ কিছু পরিকাঠামো নির্মাণের কাজে যুক্ত হতে পেরেছে। এতে পাক নেতাদের একাংশ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। আমেরিকা কিংবা নেটো-উত্তর আফগানিস্তানে পাক-ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলির প্রভাব উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেলে ভারতের পক্ষে তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক হতে পারে। এই প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বিতীয় ইনিংসের আফগান নীতির দিকে সাউথ ব্লকের কর্তাদের কড়া নজর থাকবেই।

অভিবাদন। ওবামার জয় ঘোষণার পরে। শিকাগো,
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ৬ নভেম্বর, ২০১২। ছবি: এ এফ পি
নজর থাকবে ইরান সম্পর্কে ওয়াশিংটনের দৃষ্টিভঙ্গির দিকেও। মিট রোমনি নির্বাচিত হলে এই বিষয়ে আরও কঠোর অবস্থান নিতেন, এমন আশঙ্কাই প্রবল ছিল। পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলিতে অনেকটাই অনিয়ন্ত্রিত ‘আরব বসন্ত’ এমনিতেই ওবামা প্রশাসনকে যথেষ্ট চাপে রেখেছিল। এই অবস্থায় দ্বিতীয় পর্যায়ে ওবামা আরও কড়া পদক্ষেপ করেন, না কূটনৈতিক প্রয়াসের উপর গুরুত্ব দেন, তা দেখবার। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি।
এ দিকে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নানা প্রসঙ্গে আমেরিকা ও চিনের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। এই উত্তেজনার আঁচ থেকে ভারত নিজেকে পুরোপুরি বাঁচাতে পারেনি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্বে নয়াদিল্লি ওয়াশিংটনের কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। অবশ্য এই প্রসঙ্গ বা সীমান্ত-বিরোধ চিন ও ভারতের দূরত্ব বাড়ালেও অন্য দিকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের অগ্রগতি এশিয়ার এই দুই বৃহৎ প্রতিবেশীকে এক ভিন্নতর অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ওবামার দ্বিতীয় ইনিংসে নয়াদিল্লিকে সেই ভারসাম্যের কূটনীতি বজায় রাখতে হবেই। প্রসঙ্গত, ওবামার পুনর্নির্বাচনে বেজিংও কিছুটা স্বস্তিতে। অচেনা রোমনির সঙ্গে যুঝতে হবে না যে!
বস্তুত, ওবামার এই জয়ে ভারতের উল্লাসের কোনও সঙ্গত কারণ নেই। তাঁর প্রথম ইনিংসে ওবামা নয়াদিল্লির খুব কাছে এসেছিলেন, এমন কথা বলা শক্ত। বরং নানা বিষয়ে দুই দেশের মতান্তর ছিলই। তবে দুটি গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে যে পরিণত কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন, ইদানীং তার কিছুটা ইঙ্গিত মিলেছে। মনে রাখা দরকার, উপমহাদেশে অতীতে যে ভাবে আমেরিকার কর্তারা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতেন, সেই অবস্থান থেকে ওয়াশিংটন ওবামা-যুগে কিছুটা সরে এসে এই দুই প্রতিবেশীকে পৃথক পৃথক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেষ্টা করেছে। ভারতের পক্ষে এই প্রাপ্তিও কম নয়।
সুতরাং, সামগ্রিক ভাবে, ওবামার এই জয় নয়াদিল্লির কাছে, সুখের না হোক, হয়তো কিছুটা স্বস্তিরই। চেনা লোক, চেনা অবস্থান, যতটুকু স্বস্তি দেয় আর কী। অন্য দিকে, ফের নির্বাচনের আঙিনায় আসার সুযোগ যেহেতু আর নেই, তাই ওবামা না-রাখা কথা রাখতে তৎপর হতেই পারেন। মার্কিন কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের জয় তাঁকে কিছুটা প্রতিহত করলেও, এটা অসম্ভব নয়। এই অবস্থায়, সাধারণ নির্বাচনের অদূরে দাঁড়ানো ভারতের সাপেক্ষে ওয়াশিংটন কী অবস্থান নেয় এবং এশিয়া মহাদেশে কী ভাবে পা ফেলে, সে দিকে আমাদের নজর থাকবেই। নিরাপত্তার স্বার্থে, অর্থনীতির স্বার্থেও।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.