উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দে অবস্থিত দারুল উলুম শরিয়তি বিধান ব্যাখ্যা করা এবং তাহার ভিত্তিতে মুসলিমদের উদ্দেশে রকমারি ফতোয়া জারি করার কর্তৃত্বসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় মুসলিমদের জীবন ও সমাজ, এমনকী রাজনীতি সংক্রান্ত সমস্যা লইয়াও প্রায়শ এখান হইতে ফতোয়া জারি হয়। অধিকাংশ ফতোয়াই অকিঞ্চিৎকর নানা বিষয়ে, কিছু-কিছু এমনকী হাস্যকরও। কখনও-সখনও অবশ্য দারুল উলুমের ফতোয়া দফতর ‘দারুল ইফ্তা’ সম্প্রদায়ের পক্ষে সদর্থক দিকনির্দেশও করিয়া থাকে। মুসলিম পুরুষের বহুবিবাহ বিষয়ে সর্বশেষ ফতোয়াটি তেমনই একটি। ইন্টারনেটে এক বিবাহিত মুসলিমের পাঠানো একটি প্রশ্নের জবাবে দারুল উলুমের বিধানপ্রথমা স্ত্রী জীবিত থাকিতে দ্বিতীয় বিবাহে প্রবেশ করার ধারণাটি ঠিক নয়। শরিয়ত মুসলিম পুরুষের একাধিক স্ত্রী রাখা মঞ্জুর করিলেও ভারতীয় সমাজে ও প্রথায় এই বন্দোবস্ত গ্রহণযোগ্য নয়। ইহা অনেক অবাঞ্ছিত সমস্যা সৃষ্টি করে এবং সকল স্ত্রীর প্রতি সাম্য ও সুবিচার করাও সম্ভব হয় না। ফতোয়াটি বৈপ্লবিক। প্রথমত ইহাতে এক স্ত্রীতেই সন্তুষ্ট থাকার বিষয়ে কোরানের যুক্তিটি মনে করাইয়া দেওয়া হইয়াছে। দ্বিতীয়ত, ইহাতে ধর্মীয় বা সম্প্রদায়গত পরিচয় আঁকড়াইয়া থাকার পাশাপাশি ভারতীয়ত্বকে বরণ করার ঐতিহাসিক নিয়তিটিও স্মরণ করানো হইয়াছে। ভারতীয় মুসলিমকে যে কেবল শরিয়ত মানিলেই চলিবে না, ভারতীয়ত্বও শিরোধার্য করিতে হইবে, এই ইঙ্গিত এখানে স্পষ্ট। শুধু দারুল উলুম নয়, নিখিল ভারত মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডও বহুবিবাহের বিপক্ষেই রায় দিয়াছে। মুসলিম পুরুষের বহুবিবাহ যে গৃহযুদ্ধ-দীর্ণ আরবভূমিতে পুরুষদের আকাল ও নারীদের অরক্ষিত পড়িয়া থাকার গ্লানি, অপমান ও অনিশ্চয়তা হইতে পরিত্রাণ করার জন্যই বিধান-বদ্ধ হইয়াছিল, ল’ বোর্ডের সদস্য ড. নইম হামিদ তাহাও স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। সেই পরিস্থিতি আজ নাই তাহা বুঝিলে বিধানটিকেও বর্জন করার শুভবুদ্ধি জাগিবে।
ভারতীয় মুসলিম সমাজে যে একটা পরিবর্তন ও জাগরণ দেখা দিতেছে, তাহার লক্ষণগুলি স্পষ্ট। ইমাম ও মৌলবিদের একটি অংশ সম্প্রদায়কে শিক্ষাদীক্ষায়, আধুনিক চিন্তায় উন্নত করিতে উদ্গ্রীব। মাদ্রাসা-মক্তবের ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার ও পড়াইবার আগ্রহও বাড়িতেছে (বর্তমানে মুসলিম পড়ুয়াদের চার শতাংশও মাদ্রাসায় পড়ে না)। আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত চেতনার বিকাশ শিক্ষার হাত ধরিয়াই ঘটিতে পারে, ঘটিতেছেও। ভারতে বোরখার ব্যবহার কমিতেছে, মুসলিম মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, এমনকী বাল্যবিবাহের আয়োজন ব্যর্থ করিয়া পড়া চালাইবার, লেখাপড়া শিখিয়া ভবিষ্যতে চাকুরি করিয়া পরিবারের ভরণপোষণ করার অঙ্গীকারও লক্ষিত হইতেছে। দারুল উলুমের ইসলামি পণ্ডিতরা সম্ভবত মুসলিম সমাজের এই অভ্যন্তরীণ আন্দোলন আর উপেক্ষা করিতে পারিতেছেন না। এই শাস্ত্রীয় বিধান নিঃসন্দেহে ভারতীয় মুসলমানদের অগ্রগতির একটি সোপান হইয়া থাকিবে। |