লোবায় গেলেন না পার্থ, পুলিশ নেই এলাকায় |
কী হয়েছে খোঁজ নিতে ভিড় নেতাদের |
দয়াল সেনগুপ্ত • দুবরাজপুর |
কাটা রাস্তা ফের ভরাট করেছেন গ্রামবাসী। খুলেছে দোকানপাট। কোনও বাধা-বিপত্তি ছাড়াই একে একে ছ’টি ভ্যান সরিয়েছে পুলিশ। তবে এলাকায় পুলিশি টহল চোখে পড়েনি। ধর্নামঞ্চে আন্দোলনকারীদের অবস্থান আগের মতোই চলছে। পাশে ডিভিসি-এমটার সেই বিতর্কিত মাটি কাটার যন্ত্র। চুম্বকে এটাই বুধবারের লোবা গ্রামের ছবি।
মঙ্গলবার ওই যন্ত্র ছাড়াতে যাওয়া পুলিশকর্মীদের সঙ্গে গ্রামবাসীর সংঘর্ষে তেতে উঠেছিল লোবা এলাকা। ধর্নামঞ্চে যন্ত্র পাহারায় ব্যস্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গেই প্রথমে গণ্ডগোল বাধে পুলিশের।
|
|
এখনও গ্রামবাসীদের দখলে মাটি কাটার যন্ত্র। |
সেই ধর্নামঞ্চের সামনেই এ দিন সকাল থেকে ভিড় সংবাদমাধ্যমের ওবি ভ্যান, রাজনৈতিক দলগুলির গাড়ির। জন প্রতিনিধিদের কাছে উপেক্ষিত যে জমি-জট মঙ্গলবার বিস্ফোরণের চেহারা নিয়েছে এ দিন সকাল থেকেই সেই সমস্যার খোঁজ নিতে উপস্থিত রাজনৈতিক মহল। সকাল থেকেই মঞ্চে হাজির পিডিএস নেত্রী অনুরাধা দেব পুততুণ্ড। ছিলেন সিপিআই (এম-এল)(লিবারেশন)-এর পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল। পুলিশি আক্রমণের প্রতিবাদে লোবা, বাবুপুর, পলাশডাঙা, ফকিরবেড়ার শ’খানেক বাসিন্দা এ দিন মিছিল করে ধর্নামঞ্চের কাছে এসে অবস্থান শুরু করেন। |
|
|
লোবায় বিক্ষোভ কৃষিজমি রক্ষা কমিটির। |
বোলপুরে প্রতিবাদসভা। |
|
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে পৌঁছয় বামফ্রন্টের প্রতিনিধিদল। ছিলেন বোলপুরের সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোম, স্থানীয় ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক বিজয় বাগদি, আসানসোলের সিপিএম সাংসদ বংশগোপাল চৌধুরী, বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায়। তাঁরা ধর্নামঞ্চে গিয়ে কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন। রামচন্দ্রবাবু বলেন, “গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলনরত কৃষিজীবীদের উপরে পুলিশের এই হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয়। কৃষকদের আন্দোলনে আমরা পাশে আছি।”
পরে বাম নেতারা লোবা এবং বাবুপুর গ্রামে গিয়ে মঙ্গলবারের সংঘর্ষে আহত ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন। সিউড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, বাবুপুরের বাসিন্দা উপানন্দ মণ্ডলের মেয়ে তন্দ্রা বাম নেতাদের বলেন, “মঙ্গলবার ভোরে পুলিশ ধর্নামঞ্চে হামলা চালিয়েছে শুনেই ঘুম থেকে উঠে বাবা অন্যদের সঙ্গে সেখানে ছুটেছিলেন। পরে শুনি, বাবা পুলিশের লাঠিতে মারাত্মক জখম হয়েছেন।”
বামেদের কিছু পরেই গ্রামে পৌঁছন বিজেপি নেতা তথাগত রায়। তিনিও কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি পুলিশি ভূমিকার নিন্দা করেন। তাঁরও দাবি, “এখানে পুলিশ গুলি চালিয়েছে।” ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন তিনি। রাজ্য সরকারের উদ্দেশে তাঁর কটাক্ষ, “এই সরকারের কোনও জমি-নীতি নেই। যার জেরে এলাকার মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। সরকারি ভাবে প্রশাসনের মাধ্যমে গ্রামবাসীর স্বার্থহানি না ঘটিয়ে জমি অধিগ্রহণ করা উচিত।” |
|
সিউড়িতে আহতদের সঙ্গে কথা বলছেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়।
ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত, বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী ও তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়। |
দুপুর ২টো নাগাদ এলাকায় যান জঙ্গিপুরের সদ্য নির্বাচিত কংগ্রেস সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। ঘটনাচক্রে যিনি কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিলেন বীরভূমেরই নলহাটির বিধায়ক। তিনি সভা করে বলেন, “জমি আন্দোলনের উপরে ভিত্তি করেই এই সরকার (যে মন্ত্রিসভার অংশ কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল কংগ্রেসও) ক্ষমতায় এসেছে। তাদেরই শাসনকালে এই ঘটনা খুবই নিন্দনীয়। আমরা সিবিআই তদন্ত চাইছি।” লোবার জমি-জট কাটাতে রাজ্য সরকার চাইলে প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় সরকার মধ্যস্থতা করবে বলেও জানান অভিজিৎবাবু। তাঁর প্রশ্ন, “একটা মাটি কাটার যন্ত্র ছাড়াতে গিয়ে পুলিশ এ রকম কাণ্ড কেন ঘটাল, তা বুঝতে পারছি না।”
রাজনৈতিক নেতারা যখন সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করছেন, তখন সিউড়িতে সার্কিট হাউসে প্রশাসনিক বৈঠকে ব্যস্ত রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। প্রায় পৌনে তিন ঘণ্টার ওই বৈঠকে ছিলেন জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনা, আইজি পশ্চিমাঞ্চল গঙ্গেশ্বর সিংহ, ডিআইজি (বর্ধমান রেঞ্জ) বাসব তালুকদার, তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, এমটার দুই ডিরেক্টর বিকাশ মুখোপাধ্যায় ও নিমাই মুখোপাধ্যায়, অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার দেবস্মিতা দাস, লোবা পঞ্চায়েতের তৃণমূল সমর্থিত সিপিআই প্রধান শেখ সফিক-সহ আরও অনেকে। বৈঠক চলাকালীন হাজির হন বুধবারই দায়িত্ব নেওয়া জেলা পুলিশ সুপার মুরলীধর। |
|
সিউড়িতে বৈঠকে শিল্পমন্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র। |
বৈঠকে ঠিক কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে সে ব্যাপারে কেউ মুখ খুলতে চাননি। তবে বৈঠকে যোগ দেওয়া লোবার পঞ্চায়েত প্রধান দাবি করেন, “এটা রাজনৈতিক চক্রান্ত। পুলিশ গুলি চালায়নি। এ সব মিথ্যা অভিযোগ।” এমটা-র কর্মকর্তা বিকাশ মুখোপাধ্যায় বলেন, “গ্রামবাসী ও জমি মালিকেরা শিল্পের পক্ষে। এমটা-র ঘোষিত প্যাকেজ দেখার পরে গ্রামবাসী জমি দেওয়ার পক্ষে।” তা হলে এই সংঘর্ষ কেন? সে প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেলেনি।
ইতিমধ্যে বিকেল সাড়ে ৩টে নাগাদ লোবায় হঠাৎই গুঞ্জন ওঠে, শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সিউড়ি থেকে সেখানে আসছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রস্তুত ছিলেন কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সদস্যেরা। কিন্তু পার্থবাবু লোবা গ্রামে না ঢুকে ৬ কিলোমিটার দূরের রাজ্য সড়ক ধরে সোজা কলকাতার উদ্দেশে চলে যান।
গ্রামে না গেলেও সিউড়িতে শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, “এ ভাবে যন্ত্র উদ্ধার করতে যাওয়া ঠিক হয়নি।” যা জেনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক স্থানীয় বাসিন্দা বলেছেন, “এ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে আমাদের প্রাপ্তি এটুকুই।” |
(সহ প্রতিবেদন: ভাস্করজ্যোতি মজুমদার)
|
প্যাকেজে কী ছিল |
খনির জন্য জমির দাম একর পিছু ১২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। এলাকায় ৫০ শয্যার একটি হাসপাতাল, একটি হাইস্কুল, অজয় নদের উপর সেতু, রাস্তার উন্নয়ন, বিদ্যুদয়ন, পানীয় জলের ব্যবস্থা, যাঁদের বাড়ি-ঘর চলে যাবে তাঁদের ৫০০-৫৫০ স্কোয়ার ফুটের ঘর করে দেওয়া হবে। যাঁদের কৃষিজমি নেই অন্যের জমিকে কাজ করেন তাঁদের ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ৩০০ জন ওই টাকা পেয়েছেন।
নিমাই মুখোপাধ্যায়, ডিরেক্টর, বেঙ্গল এমটা |
|