জেলায় দু’জন সাংসদ। রয়েছেন বিধায়ক, দু’জন মন্ত্রী, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও স্থানীয় সদস্য। আছেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি, শিল্প কর্মাধ্যক্ষ। এলাকায় রয়েছেন পঞ্চায়েত প্রধান, সদস্যেরাও।
কিন্তু, জমি নিয়ে কয়েক বছর সমস্যা চলছে জেনেও গ্রামবাসীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় যাননি কেউ। গ্রামবাসীদের দাবিদাওয়ার কথা শিল্পসংস্থা বা প্রশাসনের কাছে তুলে ধরতে সচেষ্ট হননি। ফলে সমস্যা আরও ঘোরালো হয়েছে। বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু নেতা গিয়েছেন, বৈঠক করেছেন এই পর্যন্তই। লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়ে যাঁদের নির্বাচিত করছেন সাধারণ মানুষ, তাঁরা তা হলে করলেনটা কী? প্রশ্ন তুলে দিল লোবা। শেষ অবধি কাল শুক্রবার কৃষি জমি রক্ষা কমিটির প্রতিনিধিদের আলোচনার জন্য কলকাতায় ডেকেছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কৃষি জমি রক্ষা কমিটির প্রতিনিধি জয়দীপ মজুমদার বলেন, “লোবা নিয়ে যা চলছে, তার সবটা মুখ্যমন্ত্রী জানেন না বলেই আমাদের ধারণা। উনি সব জানলে দ্রুত ফয়সালা হয়ে যাবে, আশা করছি।”
নেতাদের সাড়া পেতে এত দেরি কেন? গ্রামবাসীদের প্রশ্ন, শাসক বা বিরোধী, এত দিন যাঁদের সে অর্থে ভূমিকাই ছিল না এই আন্দোলনে, আজ তাঁরাই জমি-যুদ্ধে তেতে ওঠা লোবায় কেন ভিড় করছেন? সেটা কি নিছকই জমি-আন্দোলনের রাশ ‘হাইজ্যাক’ করতে? নাকি রাজ্যকে বিপাকে ফেলে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করাটাই তাঁদের মূল লক্ষ্য?
প্রশ্ন উঠেছিল ২০০৬ সালেও। সিঙ্গুরে জমি-আন্দোলনের তখন সূচনা পর্ব। জমি দেখতে আসা টাটা গোষ্ঠীর প্রতিনিধি ও শিল্পোন্নয়ন নিগমের কর্তাদের ঢুকতে বাধা দেন চাষিরা। ফিরতে বাধ্য হয়েছিল দলটি। ওই ঘটনার পরে প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সখেদে বলেছিলেন, “কী করছিল আমাদের কৃষকসভার নেতারা? ওরা কি ঘুমোচ্ছিল?”
ছ’বছর বাদেও সেই প্রশ্ন সমান প্রাসঙ্গিক। লোবা, বাবুপুর, পলাশডাঙার বাসিন্দাদের বড় অংশের ক্ষোভ, “২০০৯-এর পর চুপিচুপি গ্রামে জমি কেনাও শুরু করে শিল্পসংস্থা। তখন কোথায় ছিলেন নেতারা?” কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতা জয়দীপ মজুমদার, ফেলারাম মণ্ডলরা সাংসদ শতাব্দীর রায়ের উদাসীনতাতেও ক্ষুব্ধ।
বাম নেতাদের ভূমিকা কী? ২০০৭-এর সেপ্টেম্বরে লোবায় ডিভিসি-এমটার খনি প্রকল্প ও ক্ষতিপূরণ-পুনর্বাসন সংক্রান্ত খসড়া তৈরি হয়। ২০০৯ থেকে জমি কেনা শুরু হয়। ২০১১-র মে পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন বামেরা। বোলপুরের সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোমের দাবি, “চাষিরা যাতে সঠিক মূল্য পান, তার জন্য সচেষ্ট ছিলাম। কিন্তু, তার আগেই আমরা ক্ষমতা হারাই।” গ্রামবাসীরা অবশ্য বলছেন, কোনও বাম নেতাকে তাঁরা পাশে পাননি। জমি জট ছাড়াতে কেন সচেষ্ট হননি দুবরাজপুরের ফব বিধায়ক বিজয় বাগদি? কেন গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলতে আসেননি বাম নেতারা? রামচন্দ্রবাবুর যুক্তি, “গ্রামবাসীরা অরাজনৈতিক ভাবে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন। তাই হস্তক্ষেপ করতে চাইনি।” বিজয়বাবুর বক্তব্য, “এমটা-কে বলেছি, আলোচনা করে ক্ষোভ-বিক্ষোভ মিটিয়ে নিন।”
দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম সভাপতি প্রিয়াঙ্কা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমার কাছ অবধি বিষয়টা আসেইনি।” আর লোবা গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল-সমর্থিত সিপিআই প্রধান শেখ সফিকের মন্তব্য, “যে পদ্ধতিতে জমি কেনা চলছিল, তা বেআইনি। প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু কেউ শোনেনি।” বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল চক্রান্তের অভিযোগের প্রতিধ্বনিই করেন।
ডিসেম্বরে কৃষিজমি রক্ষা কমিটির সদস্যরা পূর্ণেন্দু বসুর কাছে তাঁদের দাবিদাওয়া জানাতে গেলেও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বাধায় তা সম্ভব হয়নি। জানুয়ারিতে পূর্ণেন্দুবাবুর সঙ্গে দেখা করেও সমাধান সূত্র মেলেনি। জুলাইয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। ফল শূন্য। এ দিন তৃণমূলের নেতারা যতটা সচেষ্ট, জমি-জট কাটাতে তেমন উদ্যোগী হলে পরিস্থিতি অন্য রকম হত। |