দুবরাজপুরে চক্রান্তই, বলে দিলেন মমতা
আহতদের কাছে গিয়ে তুমুল অস্বস্তিতে পার্থ
দুবরাজপুরের লোবা গ্রামের ঘটনা নিয়ে বুধবার প্রশাসনিক তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য পুলিশের অতিরিক্ত ডিজি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থকে এর দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি। কিন্তু তদন্ত শুরুর আগেই মুখ্যমন্ত্রী কিছু বিষয় জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য: মঙ্গলবার পুলিশ গুলি চালায়নি। পুলিশ সংযত ছিল। গ্রামবাসীদেরও কোনও দোষ নেই। তাঁদের প্ররোচনা দিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করানো হয়েছিল। ঘটনা পূর্ব পরিকল্পিত।
অর্থাৎ, ঘটনার নেপথ্যে ‘চক্রান্তের’ গন্ধ পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
মুখ্যমন্ত্রী চক্রান্তকারীদের নামটাই শুধু বলেননি। তবে সিউড়িতে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কংগ্রেস ও সিপিএম বাইরে থেকে লোক এনে পুলিশকে আক্রমণ করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর সুরেই পার্থবাবু জানিয়েছেন, পুলিশ গুলি চালায়নি। স্বভাবতই প্রশাসনিক মহলের একাংশের প্রশ্ন, কারা এই ঘটনা ঘটাল সেটা পরিষ্কার হয়ে গেলে তদন্তের আর কী প্রয়োজন?
রাজ্যের একাধিক আমলা এ প্রসঙ্গে পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডকে টেনে এনেছেন। সেই ঘটনাকে ‘সাজানো’ বলে মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতা পুলিশের তৎকালীন গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেন অবশ্য তদন্ত করে জানিয়েছিলেন, পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণই হয়েছিল। পরে দময়ন্তীকে কলকাতা পুলিশ থেকেই সরিয়ে দেওয়া হয়। তাই দুবরাজপুর-কাণ্ডে মুখ্যমন্ত্রী-শিল্পমন্ত্রীর ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের বিরোধিতা কোনও সরকারি অফিসার করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে পুলিশ-কর্তাদের অনেকেই সংশয়ে।
গুলিতে জখম শ্যামল ঘোষের সঙ্গে কথা বলছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
সিউড়ি হাসপাতালে। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
এক পুলিশ-কর্তা জানান, ঘটনাস্থলে পাওয়া কার্তুজের ব্যালিস্টিক পরীক্ষা হলে সহজেই ধরা সম্ভব, গুলিটি কোন আগ্নেয়স্ত্রের। আহতদের ক্ষতস্থানের গভীরতা নিরীক্ষণ করেও আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা করা যায়। ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু ঘটনাস্থলে পাওয়া কার্তুজটির ব্যালিস্টিক পরীক্ষার দাবি তুলেছেন। প্রাথমিক পুলিশি তদন্তে প্রকাশ, সেটি ইনসাসের মতো স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের। যে রাইফেল এখন রাজ্যের বহু থানার পুলিশের হাতে দেওয়া হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণে এবং শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সিউড়িতে এ দিন গুলিচালনার তত্ত্ব খারিজ করে দিলেও সিউড়ি হাসপাতালে আহত তিন গ্রামবাসীর বক্তব্য শিল্পমন্ত্রীকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলেছে। হাসপাতালে ভর্তি শ্যামল ঘোষ পার্থবাবুকে বলেন, “আমার পেটে গুলি লেগেছে।” হাসপাতালে ভর্তি থাকা আর এক বাসিন্দা পূর্ণিমা ডোম বলেন, “চেঁচামেচি শুনে বেরিয়েছিলাম। ছেলেকে দেখতে গিয়ে পায়ে গুলি লাগে।” দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র জীবন বাগদি বলেন, “আমার কোমরের নীচে গুলি লেগেছে।” কিছুক্ষণ আগেই পুলিশের গুলিচালনার অভিযোগ খারিজ করা পার্থবাবু তখন রীতিমতো অস্বস্তিতে। তিনি বলেন, “ব্যান্ডেজ করা আছে। তা দেখে তো বলা সম্ভব নয়, কীসের আঘাতে ক্ষত হয়েছে! সবই তদন্তে বেরিয়ে আসবে।”
মুখ্যমন্ত্রী মহাকরণে দাঁড়িয়ে বলেছেন, “দুবরাজপুরে যা ঘটেছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। এমন ঘটনা ঘটা উচিত ছিল না। আমি জানি, তিন পুলিশকর্মী জখম। এক জন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। গ্রামবাসীদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই তির ছুড়েছে। তবু আমি বলব, তাঁদের দোষ নেই। তাঁদের দিয়ে তির মারানো হয়েছে। তাই গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে আমি কোনও ব্যবস্থা নেব না। পুরো বিষয়টাই পূর্ব পরিকল্পিত।”
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য: জোর করে জমি দখল তাঁর সরকারের নীতি নয়। সরকার সাধারণ মানুষ ও কৃষকদের নিরাপত্তা দিয়েই সরকার কাজ করবে। মমতা বলেন, “কেন্দ্রের দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন ও বেঙ্গল এমটা যৌথ ভাবে ওখানে একটা প্রকল্প করছে। ২০০৯ -এ তারা কিছু জমি নিয়েছিল। জ্যোতি বসুর ছেলে চন্দন তখন এমটার সঙ্গে যুক্ত। কথা বলে সমস্যা মেটাতে বলেছিলাম। তবুও এই ঘটনা দুঃখজনক।”
যে সব প্রশ্নের জবাব নেই
মুখ্যমন্ত্রী বলছেন তা যদি হয়
গ্রামবাসীদের কোনও দোষ নেই এত পুলিশকর্মী আহত হল কী ভাবে
পুলিশ গুলি চালায়নি ঘটনাস্থলে পাওয়া কার্তুজ কোথা থেকে এল
এত আক্রমণের মুখে পুলিশ সংযত ছিল পুলিশ সুপারকে সরিয়ে দেওয়া হল কেন
গ্রামবাসীদের দিয়ে তির ছোড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা দফতর তাহলে কী করছিল
এটা পরিকল্পিত চক্রান্ত স্থানীয় পঞ্চায়েত তৃণমূলের, তারা কী করছিল
মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, “গ্রামবাসীদের খেপিয়ে তোলার পিছনে প্ররোচনা ছিল। এই ঘটনায় কোন কোন কয়লা-মাফিয়া যুক্ত, তা প্রশাসনিক তদন্তে জানা যাবে।” শিল্পমন্ত্রী অবশ্য তদন্তের আগেই সিউড়িতে জানান, চক্রান্তের সঙ্গে কারা যুক্ত। “সিপিএম ও কংগ্রেসের একাংশ চক্রান্ত করে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এখানে জমি নিয়ে সমস্যা নেই”, মন্তব্য পার্থর। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে সরকারের এ-ও সন্দেহ, ঘটনার নেপথ্যে ঝাড়খণ্ড থেকে আসা মাওবাদীদের হাত থাকতে পারে। আক্রমণের ধরন, তির-ধনুক নিয়ে আক্রমণ ইত্যাদি নানা বিষয় থেকে সন্দেহটি দানা বেঁধেছে বলে মহাকরণ-সূত্রের ইঙ্গিত।
গ্রামবাসীরা কী বলছেন? গোটা ঘটনাই পরিকল্পিত বলে মুখ্যমন্ত্রীর করা দাবি খারিজ করেছেন কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতা-সদস্য ও আন্দোলনকারীরা। তাঁদের বক্তব্য, “গ্রামবাসীরা নয়। পুলিশিই আক্রমণ চালিয়েছিল। আমরা তো চোর নই যে, রাতে এ ভাবে পুলিশকে আসতে হবে! পুলিশ ও ভাবে হামলা না-করলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতো।” আন্দোলনকারীদের আরও দাবি, পুলিশের সঙ্গে হামলা চালিয়েছিল বহিরাগত দুষ্কৃতী। এবং ছিলেন বীরভূম জেলা তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা, যিনি কার্যত দাঁড়িয়ে থেকে অভিযান পরিচালনা করছিলেন।
তৃণমূল নেতা পুলিশি অভিযানে উপস্থিত ছিলেন, এমন কথা শুনেছেন কৃষিজমি রক্ষা কমিটির নেতারাও। জয়দীপ মজুমদার বা ফেলারাম মণ্ডলের মতো কয়েক জনের কথায়, “ঘটনার সময়ে ওখানে ছিলাম না। তবে গুলিতে আহত গ্রামবাসী এবং অন্য আন্দোলনকারীরা ওই তৃণমূল নেতাকে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন।” জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল অবশ্য এ কথা মানেননি। সিপিএম-কংগ্রেসের একাংশ ও বহিরাগতদের উস্কানিতেই পুলিশের উপরে হামলা হয়েছে সরকারের এই তত্ত্বও মানেন না এলাকাবাসী। শেখ ইব্রাহিম, শেখ সামসুদ্দিন, স্বপন মণ্ডল, ধীরেন ঘোষেরা বলছেন, “মানুষ নিজেদের তাগিদে পুলিশকে প্রতিরোধ করেছে। এখানে বাইরের লোকের মদতের দরকারটাই বা কী? সিপিএম, কংগ্রেস, কেউই প্ররোচনা দেয়নি।”
দুবরাজপুর-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে বিরোধীরা। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “ওঁরা যা বলেছেন, তাতে অনেক প্রশ্নেরই জবাব মিলছে না! ওঁরা সবেতেই কংগ্রেস-সিপিএমের ভূত দেখেন। এখানেও দেখেছেন! বলছেন, বাইরের লোক ছিল। তা-ই হলে তদন্তের দরকার কী?” যে বেঙ্গল-এমটা সংস্থাকে নিয়ে বিতর্ক, তার সঙ্গে জ্যোতি বসুর পুত্র জড়িত বলে মুখ্যমন্ত্রীর তোলা অভিযোগ প্রসঙ্গে সূর্যবাবুর প্রশ্ন, “সবই যদি মুখ্যমন্ত্রী জেনে থাকেন, তা হলে পুলিশি অভিযান করতে গেলেন কেন?” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “প্রশাসনিক তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে নিজেই উপসংহার টেনে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী! তদন্ত না-করেই উনি ষড়যন্ত্র খুঁজে পাচ্ছেন!” প্রদীপবাবুর বক্তব্য, “এক সময়ে উনি কৃষকদের পাশেই ছিলেন। গ্রামবাসীরা যে মেশিনটা আগলে রেখেছিলেন, তা তুলে আনতে পুলিশ পাঠালেন কেন?” পার্থবাবু সিউড়ি গেলেও শেষ পর্যন্ত লোবায় যাননি। জরুরি কাজ রয়েছে বলে কলকাতা ফিরে যান।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.