|
|
|
|
বারাক-হিলারির ধারাবাহিকতা
অগ্নি রায় • নয়াদিল্লি |
মন্দের ভাল!
বারাক ওবামার দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করার ঘটনাকে ঠিক এ ভাবেই দেখছে নয়াদিল্লি। ওবামার জয়ের খবর আসার পর অভিনন্দন জানিয়ে একটি দীর্ঘ বার্তা হোয়াইট হাউসে পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সেখানে কূটনৈতিক সৌজন্য মেনে ওবামা জমানার সপ্রশংস উল্লেখই করেছেন তিনি। অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও। কিন্তু সাউথ ব্লক ঘরোয়া ভাবে জানাচ্ছে, ওবামা ফের নির্বাচিত হওয়ায় ভারতের বিরাট উল্লসিত হওয়ার মতো কোনও কারণ নেই। আবার নতুন করে খারাপ হওয়ারও কিছু নেই।
তবুও সব মিলিয়ে কেন এই ফলাফলকে মন্দের ভাল বলেই মনে করছে নয়াদিল্লি?
প্রাক্তন এবং বর্তমান কূটনীতিবিদ তথা বিশেষজ্ঞরা একটি ব্যাপারে একমত। তা হল, বারাক ওবামা ভারতীয় নেতৃত্বের ‘পড়া বই’। তাঁর কূটনীতি ভারতের ‘চেনা বিষয়’। ফলে আমেরিকার সঙ্গে ভবিষ্যৎ দৌত্য যেমনই হোক— ‘অচেনা বন্ধুর’ সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক পাতানোর থেকে তা সুবিধাজনক। বিশেষ করে হিলারি ক্লিন্টনের বিদেশ সচিব পদে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনাকে ভারতের পক্ষে ইতিবাচক বলেই মনে করছেন তাঁরা। পরপর দুই দফায় একই ব্যক্তির বিদেশ সচিব হওয়ার নজির নেই ও দেশে। ওবামা ফের জিতলে, বিদেশ সচিব কে হবেন তা নিয়ে কিছু ভাবনাচিন্তার কথাও শোনা যাচ্ছিল ভোটের আগে। শোনা যাচ্ছিল, রাষ্ট্রপুঞ্জে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সুজান রাইসের নাম। এ দিন কিন্তু মার্কিন সূত্রে ইঙ্গিত মিলেছে, থাকছেন হিলারিই। এটা ঠিকই যে ঐতিহ্যগত ভাবে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক মধুর নয়। কিন্তু গত চার বছরে ভারত সম্পর্কে হিলারির যে অবস্থান ও ভূমিকা দেখা গিয়েছে, তাতে আরও কিছু দিন (শোনা যাচ্ছে এক-দেড় বছর) তাঁর ওই পদে থেকে যাওয়াটা দিল্লির পক্ষে স্বস্তিরই খবর।
কারণ, রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রোমনি জিতে এলেও ভারত-আমেরিকা সম্পর্কে সেই ‘বুশ-যুগ’ হয়তো ফিরত না। জর্জ বুশ যে ভাবে প্রায় একক চেষ্টায় ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ককে এক অভূতপূর্ব উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তার ধারে কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা আগামী দিনে সম্ভব নয় বলেই মনে করা হচ্ছে।
বুশ জমানায় ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রদূত রণেন সেন। আজ ওবামার পুনরাভিষেকের পর আবেগহীন ভাবে তিনি জানাচ্ছেন, “এই ফলাফল প্রত্যাশিত ছিল। তবে এর ফলে ভারত-মার্কিন সম্পর্কে যে বিরাট কিছু ইতরবিশেষ হবে, এমনটা মনে হয় না। একটাই সুবিধা, ওবামার সঙ্গে গত চার বছর কাজ করার সুবাদে আমরা তাঁকে জানি।” তবে ২০০৮ সালে জিতে আসার পর যে ভাবে ভারত-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন ওবামা সেই বিষয়টিও আজকের দিনে মনে করিয়ে দিচ্ছেন রণেন। বলছেন, “প্রথম বার জিতে আসার পরই টাইম ম্যাগাজিন-এ একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ওবামা। সেখানে কাশ্মীর সম্পর্কে যে মন্তব্য তিনি করেছিলেন, তা পুরোপুরি ভাবে ভারতের অবস্থান-বিরোধী। কাশ্মীরকে একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসাবে মর্যাদা দেওয়ার প্রশ্নে সওয়াল করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এই নিয়ে যথেষ্ট অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল ভারতে। পাকিস্তান সম্পর্কেও তখন যথেষ্ট নরম মনোভাব নিয়ে চলছিল ওবামা প্রশাসন।”
ওবামা তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করার মুহূর্তে তাই বেশ কিছু প্রশ্নও ঝুলছে সাউথ ব্লকের উপরে। এক, পরমাণু দায়বদ্ধতা বিলের গেরো কাটিয়ে কত তাড়াতাড়ি মার্কিন পরমাণু সংস্থাগুলি ভারতে বিনিয়োগ শুরু করবে? ভারত খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের দরজা খোলার পর ওয়ালমার্টের মতো সংস্থাগুলির আসতে আর কত সময় লাগবে? ভারতের দীর্ঘ দিনের শক্তি-সহচর ইরানকে নিয়ে কি নয়াদিল্লির উপর চাপ আরও বাড়ানো হবে? চিনের নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে কী নীতি নিয়ে এগোবেন ওবামা? ভারতের স্বার্থ তাতে অক্ষুণ্ণ থাকবে তো? কাজের আউটসোর্সিং-এর প্রশ্নে কতটা কড়া নীতি নেবে ওবামার দ্বিতীয় প্রশাসন?
প্রাক্তন কূটনীতিবিদ জি পার্থসারথি মনে করেন, যিনিই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোন না কেন, আমেরিকার ভারত-নীতিকে উল্টেপাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। তাঁর কথায়, “ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট মার্কিন সেনেটে দুই দলের সমর্থন রয়েছে। ফলে রোমনি এলেও ওবামার নীতির থেকে খুব বেশি তফাৎ হত না। সে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা এখনও কাটেনি। বেকারি একটি বড় সঙ্কট। এমন একটি প্রেক্ষিতে ভারতে কাজের আউটসোর্সিং-এর প্রশ্নে নরম নীতি নেওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্টেরই, তা তিনি যে দলেরই হোন না কেন।”
তবে এই সব আশঙ্কার মধ্যেও আপাতত দু’টি বিষয়কে আশাজনক বলেই মনে করছেন ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা। এক, সম্পর্কের ধারাবাহিকতা নষ্ট হচ্ছে না। সাউথ ব্লকের এক সংশ্লিষ্ট অফিসারের কথায়, “বেশ কিছু জায়গায় আমাদের সঙ্গে আমেরিকার কৌশলগত বোঝাপড়া রয়েছে, আবার অনেক বিষয়েই রয়েছে মতানৈক্য। গত চার বছরের দৌত্যের ফলে সবটাই টেবিলের উপর স্পষ্ট ভাবে রাখা রয়েছে। নতুন প্রশাসন এলে গোটা বিষয়টিই এক-দেড় বছর পিছিয়ে যেত। প্রথম থেকে আবার দ্বিপাক্ষিক সমীকরণ তৈরি করতে হত। এ ক্ষেত্রে যে ভাবে চলছে, সে ভাবেই চলবে। তিক্ততা এবং প্রাপ্তি মিলিয়ে মিশিয়ে।”
দ্বিতীয় আশার বিষয়, ওবামার কূটনীতিতেও কিন্তু গত চার বছরে বদল এসেছে। রণেন সেনের মতে, ২০০৮-এর এবং আজকের ওবামা কিন্তু বিদেশনীতির প্রশ্নে এক ব্যক্তি নন। প্রাক্তন বিদেশসচিব কানোয়াল সিব্বলও একই সুরে বলছেন, “কাশ্মীর, পাকিস্তান অথবা চিন সংক্রান্ত নীতির ক্ষেত্রে ওবামা যে ভাবে শুরু করেছিলেন তাতে ভারত প্রসঙ্গে তাঁর বোঝাপড়ার অভাবটাই স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখেছি, পরে তিনি কৌশল অনেকটাই বদলেছেন। অবশ্যই ভূকৌশলগত পরিস্থিতির চাপে তাঁর এই বদল। চিনের প্রশ্নে তিনি এখন ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলছেন। ওসামা-হত্যা পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানের উপর যারপরনাই চাপ বাড়িয়েছে ওয়াশিংটন। ইসলামাবাদের মদতপুষ্ট জঙ্গিরা যে ভারতের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালাচ্ছে এ বিষয়টি মান্যতা দিয়েছে তাঁর প্রশাসন। পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারেও কাটছাঁট করা হয়েছে। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার কূটনীতিতে ভারতকে গুরুত্ব দেওয়া যে প্রয়োজন সে কথা দেরিতে হলেও ঠেকে শিখেছেন ওবামা।”
নিজের দেশের স্বার্থেই পরের দিকে সন্ত্রাসের প্রশ্নে হিলারি যে ভাবে পাকিস্তানকে চাপ দিয়ে গিয়েছেন, (এমনকী ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়েও) তা সাউথ ব্লকের অবস্থানকেই মজবুত করেছে। এশিয়ায় এলেই ভারত ও পাকিস্তান সফরকে এক সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা গিয়েছে আগের বিদেশ সচিব বা অন্য মার্কিন কর্তাদের। হিলারি এই ওপর-ওপর ভারসাম্যের কূটনীতিতে বেঁধে রাখেননি মার্কিন বিদেশ নীতিকে। ভারতে এসেছেন, কিন্তু ইসলামাবাদে যাননি, এমনটাও দেখা গিয়েছে। আমেরিকার ছক বাঁধা বিদেশ নীতিকে অন্ধ ভাবে অনুসরণ করতেই হবে এমনটা মনে করেননি ওবামাও। যেমন ইজরায়েলের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কের ভিতে দাঁড়িয়েও মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে গত চার বছরে এক বারও সে দেশে পা দেননি তিনি। ইজরায়েলের কট্টর প্যালেস্তাইন বিরোধী নেতানিয়াহু ও ওবামার সম্পর্কের সমীকরণটা বেশ ঠান্ডা। তেমনই বুশ জমানা থেকেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শরিক পাকিস্তানের মাটিতেই ওসামা বিন লাদেনের নিধন ও তার পর ইসলামাবাদের উপর চাপ বাড়িয়েছেন ওবামা, হিলারিরা। এই চেনা জুটি যে বজায়ে থাকছে, সেটা সাউথ ব্লকের কাছে কিছুটা স্বস্তির।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁর বার্তায় ভারত-মার্কিন সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করার আহ্বানই জানিয়েছেন ওবামার কাছে। তাঁর কথায়, “এ ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহই নেই যে ভারত-মার্কিন অংশীদারি আরও জোরালো করার ক্ষেত্রে আমাদের আরও অনেক কিছু করার রয়েছে।” |
|
|
|
|
|