|
|
|
|
হলদিয়ার জেরে সঙ্কট গভীর |
মাস পয়লার পেনশনে এ বার ছন্দপতন বন্দরে |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
ড্রেজিং খাতে কেন্দ্রের টাকা আসেনি। এ অবস্থায় খরচ সামলাতে যার আয় ছিল বড় ভরসা, এবিজি-কাণ্ডের জেরে সেই হলদিয়া বন্দরেরও রোজগারে টান পড়ায় কলকাতা বন্দরের ভাঁড়ারে দুর্দশার ছায়া আরও ঘনিয়েছে। এতটাই যে, পয়লা তারিখে কলকাতা বন্দরের ১৮ হাজার অবসরপ্রাপ্ত কর্মীর পেনশন হচ্ছে না দু’মাস ধরে!
আইন-শৃঙ্খলা সমস্যার দরুণ গত দেড় মাস যাবৎ হলদিয়া বন্দরে এবিজি মাল খালাসের কাজ করতে পারেনি। ফলে কলকাতা বন্দর শুধু অক্টোবরেই অন্তত ৭ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে বলে বন্দর-সূত্রের খবর। সঙ্কট আরও ঘোরালো হয়েছে দিল্লি থেকে ড্রেজিং-ভর্তুকির টাকা না-আসায়। নদী-বন্দর হওয়ার সুবাদে পলি কেটে নাব্যতা বাড়ানোর জন্য ফি বছর চারশো কোটি টাকা ড্রেজিং-ভর্তুকি পেত কলকাতা। কিন্তু সাম্প্রতিক কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক টানাপোড়েনের পরিণামে তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে বন্দর-কর্তাদের একাংশের দাবি।
তাই বন্দরকে এখন পলি কাটতে হচ্ছে নিজের টাকায়। ভাল রকম টান পড়েছে তহবিলে। যার প্রতিফলন পড়েছে অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন অ্যাকাউন্টেও। হলদিয়া বন্দর ও কলকাতা বন্দরের অন্যান্য অফিসের প্রায় ১৭ হাজার প্রাক্তন কর্মীর এ মাসের পেনশন তাঁদের অ্যাকাউন্টে ইতিমধ্যে জমা পড়লেও নেতাজি সুভাষ ডক, খিদিরপুর ডক ও বন্দরের সদর অফিসের অন্তত ১৮ হাজার পেনশনভোগী এখনও টাকা পাননি। গত মাসেও টাকা পেতে এক সপ্তাহ দেরি হয়েছিল। রবিবার এক পেনশনভোগীর প্রতিক্রিয়া, “এত দিন দেখে আসছিলাম, পাক্কা মাসের পয়লা তারিখে অ্যাকাউন্টে টাকা চলে আসে, তার নড়চড় নেই। সত্যি বলতে কী, এ ব্যাপারে বন্দর-কর্তৃপক্ষের তুলনা ছিল না। অক্টোবরেই প্রথম দেখলাম, পেনশন জমা হতে হতে আট তারিখ গড়িয়ে গেল! নভেম্বরে এখনও
হয়নি। কবে হবে, ওঁরা তা-ও বলতে পারছেন না।”
বন্দরের পেনশন হয়ে থাকে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-সহ পাঁচটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক মারফত। কলকাতা বন্দরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মীরা স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে পেনশন পান, হলদিয়ার জন্য অন্য চারটি ব্যাঙ্ক।
বন্দর-সূত্রের খবর: স্টেট ব্যাঙ্কের পেনশন অ্যাকাউন্টগুলোয় এখনও টাকা জমা পড়েনি। কলকাতা বন্দর পেনশনার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি অনন্তকুমার পারিয়াল এ দিন বলেন, “বন্দরের অর্থ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ওঁরা জানিয়েছেন, পেনশনের টাকা সময় মতো জোগাড় হয়নি। তবে আশ্বাস দিয়েছেন, গত মাসে যে ভাবে একটু দেরিতে পেনশন দেওয়া হয়েছিল, কালীপুজো-ভাইফোঁটার মাসেও সে ভাবে দেওয়া হবে।” অনন্তবাবু জানান, যে হেতু গত মাসে ৮ তারিখে পেনশন হয়েছে, তাই এ বার আর দু’-চার দিন তাঁরা দেখবেন। “তার মধ্যে টাকা না-এলে বড়সড় আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে।” মন্তব্য করেন তিনি।
অ্যাসোসিয়েশন সূত্রের দাবি: হলদিয়ায় এখন এবিজি-র ছাঁটাই এবং কর্মহারা শ্রমিকেরা ধর্না-মঞ্চ বেঁধে আন্দোলন করছেন। পেনশন না-পেয়ে প্রাক্তন কর্মীরাও আন্দোলনে নামলে সেখানকার পরিস্থিতি আরও জটিল হবে ভেবেই হলদিয়া বন্দরের পেনশনপ্রাপকদের টাকা ঠিকঠাক মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কলকাতা বন্দর-কর্তৃপক্ষের (কেওপিটি) অধীনে দু’টো বন্দর কলকাতা ডক সিস্টেম এবং হলদিয়া ডক সিস্টেম।
বন্দর-সূত্রের খবর: কলকাতার লোকসান বেশ কিছুটা পুষিয়ে দিচ্ছিল হলদিয়া। প্রায় ১০ হাজার কর্মী ও ৩৩ হাজার অবসরপ্রাপ্তের বেতন-পেনশন মেটাতেও কেওপিটি অনেকাংশে হলদিয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকছিল। উপরন্তু গত দু’বছর যাবৎ হলদিয়ায় কর্মরত এবিজি’র কাছ থেকে দেড়শো কোটি টাকা রাজস্ব আসায় অর্থ সংস্থানের জন্য কলকাতার হলদিয়া-নির্ভরতা ক্রমে বাড়ছিল। মাস দেড়েক হল, ছবিটা উল্টে গিয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে হলদিয়ায় কাজ বন্ধ করে দিয়েছে এবিজি। এখন তাদের থেকে রাজস্ব তো আসছেই না, উল্টে মোটা ক্ষতিপূরণ চেয়ে বন্দরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পণ্য খালাসকারী সংস্থাটি। ঠিক সময়ে পর্যাপ্ত মাল খালাস না-হওয়ায় বন্দরের সার্বিক আয়ও ধাক্কা খেয়েছে। কী রকম?
বন্দর-সূত্রের খবর: বিভিন্ন সংস্থা এখন পারাদ্বীপ-ধামড়া কিংবা বিশাখাপত্তমে জাহাজ ভেড়াতে চাইছে। হলদিয়ায় অক্টোবরে শুকনো পণ্য (ড্রাই বাল্ক) ওঠা-নামা মার খেয়েছে প্রায় ৩০%। কিছু দিন আগেও স্যান্ডহেডে পনেরো-কুড়িটা জাহাজ সব সময়ে অপেক্ষা করত হলদিয়া বা কলকাতায় ভেড়ার জন্য, সম্প্রতি সংখ্যাটা নেমে হয়েছে পাঁচ, বড়জোর সাত। অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি উন্নতিরও বিশেষ আশা দেখছে না জাহাজি মহল।
কর্তৃপক্ষ কী বলেন?
বন্দরের চেয়ারম্যান মণীশ জৈন এ জন্য বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দাকে দায়ী করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “সারা বিশ্বেই ইস্পাত, তাপবিদ্যুৎ-সহ মূল শিল্পগুলোয় ভাটা চলছে। কাঁচামাল (কয়লা, মেট কোক, লাইম স্টোন, ম্যাগনেসিয়াম, আকরিক লোহা ইত্যাদি) আমদানি-রফতানি কমে গিয়েছে।” শুধু কলকাতা নয়, গত তিন মাসে দেশের ১১টি বড় বন্দরেই পণ্য খালাসের পরিমাণ কমেছে বলে চেয়ারম্যানের দাবি। বন্দরের চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার তথা আর্থিক উপদেষ্টা শ্যামলকুমার ভট্টাচার্যও তহবিলে টানাটানির কথা মানতে চাননি। “অর্থের কোনও সমস্যা নেই। পেনশনভোগীরা যাতে টাকা পেয়ে যান, তার ব্যবস্থা হচ্ছে।” আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।
|
|
|
|
|
|