এ দেশে প্রবেশ অবৈধ ভাবে। তা সত্ত্বেও এ দেশের সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র, রেশন কার্ড, এমনকী জন্মের শংসাপত্রও মিলে যাচ্ছে সহজেই। সবেতেই রয়েছে সরকারি শিলমোহর। হুগলির কানাইপুর থেকে অনুপ্রবেশকারী ছয় বাংলাদেশিকে ধরে পুলিশ যতটা না স্বস্তিতে, তার চেয়ে ঢের আশঙ্কায় এ দেশে থাকার সরকারি ছাড়পত্র কাদের হাত দিয়ে তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে। প্রশাসনিক দফতরের কারও যোগসাজস ছাড়া যে ওই সমস্ত নথিপত্র বের করা অসম্ভব, তা মানছেন তদন্তকারীরা। গোটা বিষয়টি পুলিশের তরফে প্রশাসনিক কর্তাদের জানানো হয়েছে।
হুগলির পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, “গোটা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।” শ্রীরামপুরের মহকুমাশাসক জয়সি দাসগুপ্ত বলেন, “উদ্ধার হওয়া ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড পুলিশের কাছে দেখতে চেয়েছি। তা দেখে প্রশাসনিক স্তরে তদন্ত শুরু করব। সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পুলিশ জানায়, শনিবার দুপুরে কানাইপুরের বারুজীবী কলোনি থেকে ৬ বাংলাদেশিকে গ্রেফতার করা হয়। বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার মতলব উত্তর এবং মতলব দক্ষিণ থানা এলাকার বাসিন্দা ওই ব্যক্তিরা কেউ পাসপোর্ট দেখাতে পারেনি।
কী কারণে এবং কী ভাবে তাঁরা পশ্চিমবঙ্গে এলেন? ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, এর মূলে আছেন বেলঘড়িয়ার বাসিন্দা সুকান্ত মজুমদার নামে এক যুবক। তিনি আগে চাঁদপুরেই থাকতেন। তাঁর পরিবারের লোকজন সেখানে থাকে। কলকাতার একটি নির্মাণ সংস্থায় কাজ দেওয়ার নাম করে সেখানকার পাঁচ যুবকের প্রত্যেকের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা করে নেন ওই যুবক। পুলিশের দাবি, সুকান্তর বাবা ধীরেন্দ্রনাথবাবুর মাধ্যমে টাকার লেনদেন হয়।
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, গত ২৪ অক্টোবর অর্থাৎ বিজয়া দশমীতে ধীরেন্দ্রনাথবাবুর সঙ্গেই বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে অবৈধ ভাবে এ দেশে ঢোকেন ওই পাঁচ বাংলাদেশি। বারুজীবীতে বাদল রাহা নামে আদালতের এক মুহুরির বাড়িতে ভাড়া থাকছিলেন। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে শনিবার দুপুরে উত্তরপাড়া থানার পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে। শ্রীরামপুরে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্টও খোলা হয়ে গিয়েছিল ওই বাংলাদেশিদের নামে। গ্রেফতার করা হয় বাদলবাবুকেও। তবে, পুলিশের গতিবিধি টের পেয়ে সুকান্ত পালান। তাঁর খোঁজে তল্লাশি চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
জেলা পুলিশের দাবি, বাদল এবং ধীরেন্দ্রনাথবাবু বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে নথিপত্র তৈরির কাজ করছিলেন। রবিবার ধৃতদের শ্রীরামপুর মহকুমা আদালতে তোলা হয়। বাদল এবং ধীরেন্দ্রনাথবাবুকে ৩ দিন পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। বাকি ৫ জনকে ১৪ দিন জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পুলিশের সূত্র বলছে, ভোটার কার্ডগুলিতে শ্রীরামপুর মহকুমা প্রশাসনের সিলমোহর রয়েছে। জন্ম-শংসাপত্রগুলি বের করা হয়েছে রিষড়া পঞ্চায়েত থেকে। রেশন কার্ডগুলিতে শ্রীরামপুরের খাদ্য দফতরের এক আধিকারিকের সিলমোহর রয়েছে। কী ভাবে একের পর এক দফতর থেকে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র তৈরি হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন পুলিশের তদন্তকারী অফিসারেরা।
জেলা পুলিশের এক কর্তা স্পষ্টই বলেন, “প্রথমে ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই এ দেশে ঢোকা। তার পরে নাগরিক পরিচয়পত্র জোগাড় করা। অনায়াসেই এ সব করা যাচ্ছে। ফলে, কোনও জঙ্গি সংগঠনের কারও পক্ষে কী এমনটা করা দুষ্কর?” স্বভাবতই গোটা বিষয়টি নিয়ে বিএসএফ থেকে আইবি, জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসন সমস্ত দফতরের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। প্রশাসনের একাংশের অবশ্য দাবি, এ ক্ষেত্রে শংসাপত্রগুলি জাল করা হয়ে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক অতীতেই শ্রীরামপুর এবং উত্তরপাড়া থানা এলাকায় অনেক জাল শংসাপত্র বাজেয়াপ্ত হয়।
অবশ্য, সরকারি দফতরের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ তদন্ত বা দোষী সরকারি কর্মী বা অফিসারদের খুঁজে বের করা দূরঅস্ৎ, অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টাই হয় নানা মহল থেকে।
কয়েক মাস আগে উত্তর ২৪ পরগনার টিটাগর থেকে পাঁচ পাকিস্তানি নাগরিক গ্রেফতার হন ভিসার মেয়াদ ফুরনোর পরেও অবৈধ ভাবে এ দেশে বসবাস করার অভিযোগে। ওই জেলার একটি পুরসভার এক মহিলা কাউন্সিলরের দেওয়া শংসাপত্র হাতিয়ার করে এ দেশে থাকার সরকারি নথিপত্র জোগাড় করে ফেলেছিলেন ওই পাকিস্তানিরা। প্যান কার্ড জোগাড় করে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্টও খুলে ফেলেছিলেন। |