হারিকেন স্যান্ডি-র মোকাবিলায় মার্কিন সরকারের আগাম প্রস্তুতি এবং বিপর্যয় আছড়াইয়া পড়িলে তাহার ধ্বংস রোধে তুঙ্গ প্রশাসনিক তৎপরতার সুবাদে প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামা সাধারণ ভাবে প্রশংসিত হইয়াছেন। বেসুরও বাজিয়াছে বটে, কেহ কেহ বলিতেছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘাড়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে বলিয়াই ওবামার প্রশাসন বিপর্যয় মোকাবিলায় এত তৎপরতা দেখাইতেছে। অর্থাৎ জনকল্যাণের আদর্শ বা প্রেরণা নয়, রাজনীতির পাটোয়ারি বুদ্ধি ও বিবেচনাই মার্কিন প্রশাসনকে হারিকেন মোকাবিলায় এমন যুদ্ধকালীন সক্রিয়তা অবলম্বনে প্ররোচিত করিয়াছে। কথাটি ঠিক হইলেও কোনও ক্ষতি নাই। রাজনীতিকরা যদি রাজনীতির প্রয়োজনে একটি কর্তব্য যথাযথ ভাবে সম্পাদন করেন, তাহাও দেশের পক্ষে, সমাজের পক্ষে শুভ। বিপর্যয়ের মোকাবিলায় প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর কি না, তাহা অনেকাংশে নির্ভর করে প্রশাসনের সদিচ্ছা এবং সামর্থ্যের উপর। সদিচ্ছা থাকিলেই তাহা যথেষ্ট হয় না, সামর্থ্যও জরুরি। এবং, ভোটের তাগিদে সদিচ্ছা ‘নির্মাণ’ করা সম্ভব, সামর্থ্য অন্য বস্তু। হারিকেন স্যান্ডি আরও এক বার দেখাইয়াছে, সমর্থ প্রশাসন কী করিতে পারে। তাহার পরেও সমালোচনা থাকিবে: আরও তৎপরতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তাহা ভিন্ন প্রশ্ন।
তুলনায় ভারতের কথা উঠিবেই। এই দেশে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে হাজার-হাজার মানুষ নিয়মিত প্রাণ হারায়। প্লাবিত হয় সমৃদ্ধ শস্যশ্যামল জনপদ, ভাসিয়া যায় অসংখ্য গবাদি পশু, হাহাকার ওঠে নিরন্ন, পানীয় জলের সরবরাহ-বঞ্চিত, ঔষধ-চিকিৎসাবঞ্চিত দরিদ্রদের জটলায়, যাঁহাদের ক্ষুধার অন্ন, পরিধানের আচ্ছাদন, রাত্রিযাপনের ত্রিপল কিছুই জোটে না। রাষ্ট্র তথা প্রশাসন তাহার প্রস্তুতিহীনতা লইয়া অপ্রতিভ পড়িয়া থাকে, আর রাজনীতির কারবারিরা দুর্গতির ঘোলা জলে জাল ফেলিতে হাজির হইয়া যান। পরিস্থিতি কখনও এমন ঘোরালো হইয়া ওঠে (ঘূর্ণিঝড় ‘আয়লা’র বিপর্যয়ের পর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় যেমন হইয়াছিল) যে ত্রাণবঞ্চিত দুর্গতদের মুখোমুখি হইতে স্থানীয় রাজনীতিকরা, এমনকী স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও ভয় পান। হারিকেন স্যান্ডিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ভাবে মোকাবিলা করিয়াছে, তাহা হইতে কি ভারতের মতো দেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো সাইক্লোন-প্রবণ রাজ্য কিছুই শিখিতে পারে না? অবশ্যই পারে। কিন্তু সে জন্য প্রথমত সযত্নে, পরিশ্রমের সহিত তিলে তিলে বিপর্যয় মোকাবিলার পরিকাঠামো গড়িয়া তুলিতে হইবে, সেই পরিকাঠামোকে নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে সমর্থ ও তৎপর রাখিতে হইবে। এবং দ্বিতীয়ত, দলমতনির্বিশেষে দুর্গতত্রাণের কর্মসূচিতে প্রশাসনকে দায়বদ্ধ হইতে হইবে। শাসক দলের সুপারিশকৃত দুর্গতরা ত্রাণ পাইবে, অন্যরা পাইবে না, এমন বৈষম্য করা চলিবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গবাসী যেমন দলীয় আনুগত্যে নিজেদের বিভাজিত রাখিয়াছেন, তাহাতে বিপর্যয় মোকাবিলায় প্রশাসনের নিরপেক্ষ দক্ষতা প্রত্যাশা, দুরাশামাত্র। |