সব ঠিক আছে মুখ্যমন্ত্রী জানাইয়াছেন। কাহার উদ্দেশে এই আশ্বাস? সেই রাজ্যবাসীর উদ্দেশে, যাঁহারা অসহায় ভাবে পশ্চিমবঙ্গের বেদনাদায়ক মৃত্যু দেখিতেছেন? শিল্পমহলের উদ্দেশে, যাঁহারা হলদিয়া হইতে এবিজি-বিতাড়নের ঘটনায় আতঙ্কিত হইয়া কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট চিঠি পাঠাইয়াছেন? পশ্চিমবঙ্গে সব ঠিক আছে, এই কথাটি তবে কাহাকে ভুল বুঝাইবার চেষ্টায় বলা? সন্দেহ হয়, মুখ্যমন্ত্রী নিজেকেই বুঝাইতেছেন। একটি জনপ্রিয় হিন্দি ছবিতে নায়ক বিপদে পড়িলেই বুকে হাত রাখিয়া বলিতেন, ‘অল ইজ ওয়েল’। তাহাতে বিপদ কাটিত না, কিন্তু বোকা মন স্তোক পাইত। মুখ্যমন্ত্রীও হয়তো ‘সব ঠিক আছে’ বলিয়া মনকে আশ্বস্ত করিতেছেন। কারণ তিনি বিলক্ষণ জানেন, কিছুই ঠিক নাই, পশ্চিমবঙ্গের সব ভুল হইয়া গিয়াছে। সেই ‘জানা’টিকে নিজের কাছে ভুল প্রমাণের হরেক চেষ্টা করিতেছেন তিনি। শুক্রবার হলদিয়ায় তেমনই একটি চেষ্টা হইল। সেখানে বিদ্বজ্জনদের একটি প্রতিনিধিদল গিয়াছিল হলদিয়ায় আদৌ কোনও সমস্যা আছে কি না দেখিতে। সংখ্যায় নিতান্ত কম নহেন, অন্তত চল্লিশ জন। তাঁহাদের পোশাকি নাম ‘হাই পাওয়ার কমিটি ফর ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম’। এই নামের অর্থ কী, এই বিদ্বজ্জনদের সহিত শিল্পের যোগ কোথায়, বিদ্যারও আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি না, এই প্রশ্নগুলি আপাতত থাক। তাঁহারাই কেন সমগ্র সমাজের প্রতিনিধিরূপে গণ্য হইলেন, সেই প্রশ্নও আলঙ্কারিকমাত্র, কারণ উত্তরটি সর্বজনজ্ঞাত। তাঁহারা যে সত্যের সন্ধানে গিয়াছিলেন, অনুমান করা চলে, তাহাও পূর্বনির্ধারিতই ছিল। ফলে হলদিয়ায় সেই ‘সত্য’ খুঁজিয়া পাইতে তাঁহাদের বিলম্ব হয় নাই। তাঁহারা জানাইয়া দিয়াছেন, হলদিয়ায় সব ঠিক আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আশ্বস্ত হইবেন।
মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে ভুল বুঝাইতেছেন, দলের বিশ্বস্তদেরও। অবশ্য, এই শেষোক্ত শ্রেণিটিকে ভুল বুঝাইবার তেমন প্রয়োজন হয় না। তাঁহারা কী বুঝিলে নেত্রী তুষ্ট হইবেন, হিসাব কষিয়া তাহা নির্ধারণ করিয়া এই বিদ্বজ্জনরা আগেভাগেই তাহা বুঝিয়া ফেলেন। মন্ত্রীদের তো কথাই নাই। পার্থ চট্টোপাধ্যায় যেমন। মহাকরণে তাঁহার ঘরের দরজার ফলকে ‘শিল্পমন্ত্রী’ কথাটি এখনও লেখা আছে। হলদিয়ায় যাহা হইল, তাহার পর যে কোনও শিল্পমন্ত্রীই অনুশোচনায় দগ্ধ হইতেন। শ্রীচট্টোপাধ্যায় বলিয়াছেন, ‘বন্দরের ব্যাপার, বন্দরই বুঝুক’। মন্ত্রিবর, এই ঘটনা যদি ‘বন্দরের ব্যাপার’ হয়, তবে শিল্পমন্ত্রীর বিচার্য কী? ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে যথেষ্ট লোক আসিল কি না, তাহা দেখা? তিনি ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন, এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের ভাবমূর্তির কোনও ক্ষতি হইবে না। এই কথাটি সম্ভবত ঠিক। মৃতকে আর মারা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ মৃত। তাহার আর মরিবার সম্ভাবনা নাই।
পশ্চিমবঙ্গে এই শবসাধনা আর কত দিন চলিবে, মুখ্যমন্ত্রীই জানেন। অথবা, তিনিও জানেন না। পশ্চিমবঙ্গ এখন নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। শুভেন্দু অধিকারী তাঁহার কথা রাখিয়াছেন, তিনি এবিজি-কে হলদিয়ায় টিকিতে দেন নাই। সংস্থাটি যে ভাবে শ্রমিক ছাঁটাই করিয়াছিল, তাহা সাংসদের পছন্দ হয় নাই। সভ্য সমাজে এই সমস্যার সমাধান অন্য পথে হইত নাগরিক পরিসরে আলোচনার মাধ্যমে, আইনসভার বিতর্কে, এমনকী আদালতেও। পশ্চিমবঙ্গ অ-সভ্য, কাজেই বাঁদুরে টুপিতে মুখ ঢাকিয়া মাঝরাত্রে সংস্থার কর্তার স্ত্রী-কন্যাকে অপহরণ করিয়া মীমাংসা হইয়াছে। বিশ্বস্ত বিদ্বজ্জনরা সে দিকে তাকাইতে অবসর পান নাই, তাঁহারা ছাঁটাই-এসএমএস রহস্য উন্মোচনে ব্যতিব্যস্ত। বণিকমহলে কী প্রতিক্রিয়া হইল, গোটা দেশের চোখে পশ্চিমবঙ্গ কতখানি নামিয়া গেল শিল্পমন্ত্রীর মাথাব্যথা নাই, তিনি এবিজি-র অকিঞ্চিৎকরতা প্রমাণে মগ্ন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে স্তোক দিয়া সমস্যার সমাধান করিতে চাহিতেছেন। তবে তাঁহারা জানাইয়াছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনে দেখাইয়া দিবেন, জনগণ কোন দিকে। ভোটের শাকে হলদিয়ার পচা মাছ ঢাকা পড়িবে? যাঁহাদের ভাবনার গোড়াতেই এত বড় একটি গলদ থাকিয়া যায়, তাঁহারা সুপ্রশাসক হইবেন কী ভাবে? হইতে পারেন নাই। নিজেদের মিথ্যা স্তোক দেওয়া ছাড়া তাঁহাদের আর উপায়ান্তর কী? |