সম্পাদক সমীপেষু...
বাংলার জাতপাতের ‘মিথ’
আমার প্রবন্ধ পড়ে অনির্বাণ বন্দ্যোপাধায় তাঁর পত্রে (আ.বা.প ৯-১০) কয়েকটি মূল্যবান প্রশ্ন তুলেছেন। সেই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। প্রথমত উনি উল্লেখ করেছেন যে, আমি আমার ২০০৪-এর একটি বইতে প্রকাশিত মত সাম্প্রতিক কালে পাল্টে নিয়েছি। আমার বই এত মনোযোগ দিয়ে কেউ পড়েন জেনে ভাল লাগল। এই প্রসঙ্গে বলি, আমার পূর্ব মত আমি অবশ্যই পাল্টেছি, খুব খোলাখুলি ভাবেই। এই পরিবর্তিত মত-সংবলিত দুটি প্রবন্ধ ইতিমধ্যেই ছাপা হয়েছে।
২০০৪-এ মনে হয়েছিল, বহুজন সমাজ পার্টি বা সমাজবাদী পার্টি মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সমঝোতা না-করে বেশি দূর এগোতে পারবে না। পুরোনো ইতিহাসের ধারা তাই বলে। গত আট বছরে বসপা এবং সপা যে ভাবে জনসংগঠন বাড়িয়েছে, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে তা খানিকটা অভাবনীয়। অতীতের শিডিউল কাস্ট ফেডারেশন বা রিপাবলিকান পার্টির জনসংগঠনের ধারা থেকে এই সংগঠন সম্পূর্ণ ভাবে আলাদা। তাদেরও সমঝোতা করতে হয়েছে। তবে উল্টোটাও ঘটেছে অর্থাৎ মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলিকেও তাদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতার আবশ্যিকতা আগে ছিল না, এখন হয়েছে।
শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় বক্তব্যটি আরও জরুরি এবং বিশদ মন্তব্যের দাবি রাখে। স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গে জাতপাত সমস্যা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে। ২০০৪-এর বইতে এবং তারও আগে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত নমঃশূদ্রদের ইতিহাসে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম যে, ১৯৪৬-’৪৭-এর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ এবং দাঙ্গার চাপে দলিতগোষ্ঠীগুলির প্রতিবাদী আন্দোলন হারিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা মূলস্রোতে মিশেও যাচ্ছে বা। কিন্তু আমি এ-ও উল্লেখ করেছিলাম, তাতে বাঙালি সমাজে জাতপাতের সমস্যার সমাধান হয়নি মোটেই।
কিন্তু ১৯৪৭-এর পর এই দলিত প্রতিবাদী আন্দোলন কেন দুর্বল হয়ে গেল, এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর তখনও আমি পাইনি। কারণ, স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে গবেষণা না-করলে সে উত্তরটা পাওয়া সম্ভব নয়। তাই আমার সাম্প্রতিক গবেষণা এই সময়ের উপর। এবং তার প্রাথমিক সিদ্ধান্তগুলি আমার পুরোনো মত খানিকটা পাল্টাতে বাধ্য করেছে বইকী। সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস আমার নমঃশূদ্র ইতিহাসের বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ বার করেছে। তাতেই আমার পরিবর্তিত মত প্রকাশিত হয়েছে। এখানে তার বিশদ পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। সংক্ষেপে দু’চার কথা বলতে পারি।
পশ্চিমবঙ্গের দলিত সম্প্রদায়ের প্রতিবাদী আন্দোলন যে স্বাধীনতার পরে হারিয়ে যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ হল, দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা এবং আন্দোলন। বাংলার উদ্বাস্তুদের এক বিরাট অংশ বিশেষ করে যাঁরা ১৯৫০-এর পর এ-পারে এলেন, ছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের লোক। এই জরুরি তথ্যটা উদ্বাস্তু ইতিহাসে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যায় না। সবাই ‘উদ্বাস্তু’ এই নতুন আত্মপরিচয় লাভ করেন। দলিত আত্মপরিচয়টা আড়ালে চলে যায়। দেশভাগের আগে যে দলিত নেতারা জাতপাতের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফলে, দলিত আন্দোলন সাময়িক ভাবে পিছিয়ে পড়ল। কিন্তু জাতপাতের সমস্যা যে তাতে আদৌ কমল না, সেটা টের পাওয়া গেল ২০০৪ সালের শেষের দিকে। যখন প্রাথমিক স্কুলগুলিতে বাচ্চাদের মধ্যাহ্নভোজ খাওয়া নিয়ে বির্তক বাধল। দলিত স্বেচ্ছাসেবীদের হাতের রান্না ব্রাহ্মণের ঘরের ছেলেরা মুখে তুলবে না, অনেক উদারপন্থী বা বামপন্থী বাঙালি সে সম্ভাবনাটা কখনও ভেবে দেখেননি।
আসলে সমস্যাটা রয়েই গেছে। আমরা একটা ‘মিথ’ নিয়ে বাস করি যে, বাংলায় জাতপাত নেই। এটাকে মনে করি আমাদের বাঙালিয়ানার একটা প্রতীক। যেখানে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকেদের চেয়ে আমরা আলাদা। তাই এই নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাও বেশি হয়নি। তবে এই বিষয়ে ইদানীং যে ক’টি গবেষণাপত্র আমার চোখে পড়েছে, তার থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার ভাবে বেরিয়ে আসে। তা হল, ভূমিসংস্কার এবং পঞ্চায়েতি রাজ সত্ত্বেও জাতপাতের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসের যে সম্পর্ক ঔপনিবেশিক বা তার আগের যুগে ছিল, তার মূলগত পরিবর্তন খুব একটা ঘটেনি। তাই মতুয়া মহাসঙ্ঘের জনপ্রিয়তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। খাস কলকাতায় বসপা-র জনসভার ভিড় অনেক উদারপন্থী/বামপন্থী বাঙালিকে অস্বস্তিতে ফেলে। মতুয়াদের সমর্থন পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বলে দেয়, অন্যান্য প্রদেশের রাজনীতির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পার্থক্যটা এমন কিছু বিরাট নয়। তবে পার্থক্য অবশ্যই কিছুটা আছে। জাতপাতভিত্তিক হিংসাশ্রয়ী ঘটনা এখানে বিরল। তার অবশ্য কিছু ঐতিহাসিক কারণও আছে। স্বল্প পরিসরে তার আলোচনা এখানে সম্ভব নয়। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমি একমত যে, স্বাধীনতা-উত্তর পশ্চিমবঙ্গের জাতপাত নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। আমার নিজের গবেষণা এখনও মাঝপথে। তার আগে প্রত্যয় নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা দিতে যাওয়াটা ঠিক হবে না।
আরেকটি কথা। বর্তমানের উপর দাঁড়িয়েই ঐতিহাসিক অতীতের দিকে তাকান। পরিবর্তনশীল বর্তমান নতুন নতুন প্রশ্ন তুলে ধরে। আর ঐতিহাসিক সেই প্রশ্নগুলিকে অতীতের দিকে নিক্ষেপ করেন। তার উত্তর খোঁজেন। এ ভাবেই যুগে যুগে ইতিহাসের ব্যাখ্যা পাল্টায়। আশা করি, আমাদের এই নতুন বাস্তবতা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে নতুন করে ভাবাবে
এত অপচয় কেন
আজকাল বিয়ে উপনয়ন অন্নপ্রাশন জন্মদিন ইত্যাদি যে কোনও সামাজিক উৎসব উপলক্ষে আনন্দ-খুশির সঙ্গে সঙ্গে চর্বচোষ্যলেহ্যপেয় হরেক রকমের পদ পরিবেশন করা হয়। কিন্তু শঙ্কিত হই যখন দেখি, কুইন্টাল কুইন্টাল অর্ধভুক্ত বা অভুক্ত খাবার ফেলে দেওয়া হয় আঁস্তাকুড়ে। ভারত ‘খাদ্যে স্বয়ম্ভর’ হলেও সারা পৃথিবীর যত শিশু খাদ্যাভাবে অপুষ্টির শিকার, তাদের এক-তৃতীয়াংশই এ দেশের বাসিন্দা।
এ ছাড়াও, ইদানীং খাবারের সঙ্গে মাটির খুরি, গ্লাস বা পলিথিনের গ্লাসে জল দেওয়ার বদলে এক বা আধ লিটার জলের বোতল সরবরাহ করা হয়। অথচ (আজকাল) অনেকেই খাবারের সঙ্গে অতটা জল পান করেন না। তাই সিকিভাগ, আধা বা একদম না-খাওয়া জলের বোতলও শুধু এঁটো হয়ে যাওয়ার জন্য ফেলে দেওয়া হয়। কোটি কোটি অভুক্ত দরিদ্রের দেশে এত অপচয় কেন? একটু চেষ্টা করলেই তো এই রীতি বন্ধ করা যায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.