জঙ্গি আন্দোলন, না নতুন পথ,
কৌশল নিয়ে ধন্দে সিপিএম

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একদা মন্তব্য করেছিলেন, “তৃণমূল আমাদের পরিত্যক্ত পথে হাঁটছে।”
তারও আগে জ্যোতি বসু ঈষৎ ব্যঙ্গ করে সহকর্মীদের বলেছিলেন, অক্সফোর্ড অভিধানে ‘ঘেরাও’ শব্দটির অন্তর্ভুক্তি কমিউনিস্ট পার্টির অবদান।
তাদের বর্জিত পথে হেঁটে মাত্র দেড় বছরেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার শিল্পবিরোধী ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে বলে মনে করছেন সিপিএম নেতৃত্ব। তাঁদের কাছে এখন সব থেকে বড় প্রশ্ন হল, মমতার মোকাবিলায় সিপিএম কি ফের নিজেদের পরিত্যক্ত পথ অনুসরণ করবে? অর্থাৎ, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রণকৌশল নিয়ে আরও জঙ্গিপনার পথে হাঁটবে? না কি, শিল্পায়ন ও উন্নয়নের স্লোগান তুলে নতুন বাংলা গড়ার ডাক দেবে?
মঙ্গলবার থেকে আলিমুদ্দিনে শুরু হচ্ছে সিপিএম রাজ্য কমিটির দু’দিনের বৈঠক। সেই বৈঠকে দলের পথ নির্দেশিকা তৈরি করাই রাজ্য নেতাদের বড় চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে দল এখনও দোলাচলে। রাজ্য কমিটির বৈঠক শেষ হতে না-হতেই হাওড়া শরৎ সদনে সিটুর রাজ্য কমিটির বৈঠক শুরু হবে। সেই বৈঠকের খসড়া প্রস্তাবে কিন্তু পুঁজিপতি মালিকদের বিরুদ্ধে জঙ্গি আন্দোলনের কথাই বলা হয়েছে।
এই সিটুকে নিয়ে কিছু দিন আগেই সমস্যায় পড়েছিল সিপিএম। বাম শরিকেরা অভিযোগ তুলেছিল, তাদের সঙ্গে কোনও রকম আলোচনা না করেই ব্যাঙ্ক ধর্মঘট ডেকেছে সিটু। ক্ষমতা হারিয়েও সিপিএমের দাদাগিরি কমেনি বলে সরব হয়েছিল শরিকেরা। সেই ক্ষোভ প্রশমনে এগিয়ে আসতে হয় বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুকে। এর পরে রাজ্যে বাস ধর্মঘট নিয়েও সমালোচনার মুখে পড়েছিল সিটু। অন্য বাম শ্রমিক সংগঠনগুলি পাশে না দাঁড়ালেও তেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে ধর্মঘট ডাকতে অনড় ছিল তারা। পুরোপুরি এক ঘরে হয়ে পড়ায় বিমানবাবু অনুরোধকে অজুহাত করে ধর্মঘট থেকে পিছিয়ে আসে সিটু।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্যকান্ত মিশ্র, নিরুপম সেন সিপিএমের তিন পলিটব্যুরো সদস্যই মনে করেন, শ্রমিক আন্দোলনের চরিত্র এখন বদলে গিয়েছে। আর ষাট বা সত্তর দশকের জঙ্গি আন্দোলনের ধারা আঁকড়ে থাকলে চলবে না। সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
নিরুপম সেন বলেন, “সময়ের হাত ধরে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মপদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে। সেটাই সমাজবিজ্ঞান। ষাট বা সত্তরের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও এখন নেই। সে দিনের ট্রেড ইউনিয়ন আর আজকের ট্রেড ইউনিয়ন এক নয়। এখন বহু ট্রেড ইউনিয়নই উৎপাদন বৃদ্ধি ও নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সংস্থার কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করছে।”
বদলে যাওয়া বিরোধী দল হিসেবে সিপিএম-ও শাসক দলকে সাহায্য করতে আগ্রহী। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “আমরা দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে চাই। রাজ্যে শিশু মৃত্যু হলে আমরা খুশি হই না। হলদিয়া থেকে শিল্প গোষ্ঠী চলে গেলে রাজ্যেরই ক্ষতি। বামফ্রন্ট সরকার যে শিল্পায়নের নীতি নিয়েছিল তার সঙ্গে রাজ্যের উন্নয়নের প্রশ্ন জড়িয়ে ছিল। আজ যদি মমতা রাজ্যে শিল্পের পরিবেশ গড়ে তোলেন, তা হলে আমরা তাঁকে সব রকম সাহায্য করব।” সূর্যবাবুর অভিযোগ, সিঙ্গুর থেকে হলদিয়া, বিরোধী থেকে শাসক তৃণমূলের আচরণে কোনও পরিবর্তন ঘটছে না।
কিন্তু নিজেদের বদলে ফেলা যে প্রয়োজন সেটা উল্লেখ করে সিপিএমের মুখপত্রের শারদ সংখ্যায় সূর্যবাবু লিখেছেন, “বর্তমান সময়ে আরও বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য, আমাদের বক্তব্য আরও বেশি করে মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের কাজের ধারা বদলাতে হবে, নিজেদেরও বদলাতে হবে।”
বুদ্ধ-নিরুপম-সূর্য ইতিবাচক ভূমিকার উপরে জোর দিচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু দলের একটি বড় অংশ, বিশেষ করে জেলা নেতৃত্বের একাংশ মনে করছেন, তৃণমূলের জনপ্রিয়তার পারদ যদি নিম্নগামী হয় এবং সেই রাজনৈতিক পরিসর যদি সিপিএম-কে আবার দখল করতে হয়, তা হলে জঙ্গি আন্দোলনের পথে যেতে হবে। এ ছাড়া রাস্তা নেই। তাঁদের মতে, রাজ্যে তৃতীয় শক্তির বিকাশের সম্ভাবনা কম। বিজেপি ভোট কাটলেও তৃণমূল-বিরোধী পরিসর দখল করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। রাজ্য কংগ্রেসের অবস্থাও তথৈবচ। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তৃণমূলেরকে কোণঠাসা করতে পেশি শক্তির প্রয়োজন। দলের ওই অংশ মনে করে, শুধু সংস্কার ও শিল্পায়নের শ্লোগান দিয়ে ভোট হয় না।
বুদ্ধ-নিরুপম কিন্তু এখনও নতুন সিপিএম গড়ার পক্ষে। সেই কারণে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নতুন মুখকে রাজ্য কমিটিতে নিয়ে আসার কথা হচ্ছে। কিন্তু আবার একই সঙ্গে লক্ষ্মণ শেঠের স্ত্রী তমালিকাকে রাজ্য কমিটিতে এনে মেদিনীপুরের রাজনীতিতে শুভেন্দুকে মোকাবিলা করার কথা ভাবছে সিপিএমের একাংশ। যদিও এই নতুন মুখের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে দলে বিতর্ক অব্যাহত।
অর্থনৈতিক সংস্কার বা উন্নয়ন ভোট প্রচারের হাতিয়ার হতে পারে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। স্যাম পিত্রোদাকে সামনে রেখে টেলিকম বিপ্লবকে ভোট প্রচারের হাতিয়ার করতে সক্ষম হয়েছিলেন রাজীব গাঁধী। ইন্দিরা-পরবর্তী জমানায় সেই প্রথম জনপ্রিয়তাবাদের বদলে সংস্কারকে ভোট প্রচারের বিষয় করে তোলা হয়। পরে মনমোহন সিংহ পরমাণু চুক্তিকে সামনে রেখে একই চেষ্টা করেছিলেন।
এ রাজ্যে বিধান রায় যখন মুখ্যমন্ত্রী তখন জ্যোতিবাবু বিধানসভায় দাঁড়িয়ে শিল্পায়নের দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু তার দল বাস-ট্রাম পোড়ানোর সহজ পথকেই অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বুদ্ধবাবু ক্ষমতায় এসে শিল্পায়নের রথ চালাতে চেয়েছিলেন। দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে তাঁর উদার নীতিতে দল শিলমোহর দিয়েছিল। কিন্তু নন্দীগ্রামের ঘটনার পর বিধানসভা ভোটের আগে প্রকাশ কারাটের নেতৃত্বে সিপিএম আবার পিছিয়ে যায়। মতাদর্শগত বিতর্ক দলের লোকাল কমিটি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে শিকেয় তুলে জমি অধিগ্রহণ এবং কৃষি নীতির প্রশ্নে আবার পুরানো পথকেই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেন দলীয় নেতৃত্ব। নিরুপম সেনের সঙ্গে প্রভাত পট্টনয়েক ও অশোক মিত্রের মতাদর্শগত বিতর্ক ধামাচাপা পড়ে যায়। মমতার জয় দলের কট্টরবাদীদের উৎসাহিত করে তোলে।
এ বার হলদিয়া থেকে শুরু করে নানা ঘটনায় তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে যখন সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তখনও রাজনৈতিক অভিমুখ নিয়ে সিপিএমের সংশয় কিন্তু কাটেনি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.