সুনীল-স্মরণ
তাঁর প্রতি ভালবাসারও কোনও জন্ম-মৃত্যু হয় না
রাত ৯টা নাগাদ শেষ হল রবীন্দ্রসদনে কৃত্তিবাস ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিবারবর্গের উদ্যোগে আয়োজিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণসভা। মঞ্চের ওপর তখনও বুকের বোতাম খোলা, লাল স্ট্রাইপড জামা পরা সুনীলের ছবি নীরবে হাসছে। কালো স্ক্রিনের মাঝে সুনীলের হাসিমুখ, পর্দার চারদিকে সাজানো চেনা সব প্রচ্ছদ। কোথাও ‘সেই সময়’, কোথাও ‘একা এবং কয়েক জন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এখন শুধুই ছবি!
বিকেল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে যে ভিড়টা রবীন্দ্রসদনে ঢুকেছিল, তখনও তারা অদ্ভুত রকমের শান্ত। কেমন যেন ঘোরের মধ্যে। স্মৃতিরও কোনও ঘোর থাকে? যে ঘোর মনে পড়িয়ে দেয়, সুনীলের উপন্যাস ‘যুবকযুবতীরা’-য় এক চরিত্র সুধীন্দ্রনাথ দত্ত আর জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু নিয়ে বলেছিল, ‘অসুখে ভুগে ভুগে মারা গেলে ওঁদের ঠিক মানাত না।’ কবিরা কি সত্যদ্রষ্টা?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণসভায় মৃণাল সেন,
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নবনীতা দেবসেন। রবিবার।
‘আমার ভালবাসার কোনও জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না’...মাল্টিমিডিয়া স্ক্রিনে সুনীলের কণ্ঠে এই কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছিল রবিবারের স্মরণসভা। তার পর একে একে অনেকে। কখনও প্রমিতা মল্লিক, অভিরূপ গুহঠাকুরতার রবীন্দ্রসঙ্গীত, কখনও বা স্মৃতিচারণায় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নবনীতা দেবসেন, তপন রায়চৌধুরী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। দর্শকাসনে বসে স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়।
স্মরণ, কিন্তু শোকসভা নয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এ দিন বলছিলেন, প্রতিভাবানরা ধরাবাঁধা নিয়ম মানে না। সুনীলের বেহিসেবি, অফুরান প্রাণশক্তিও মানত না। বন্ধুকৃত্যে জুড়ি নেই। ‘আমার সমবয়সী বন্ধু সুনীলকে আজ আমার প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে,’ বলছিলেন তিনি।
সুনীলের মৃত্যুর পর বাঁধভাঙা, দু’কূলপ্লাবী ভিড়ের কথা বলছিলেন শীর্ষেন্দু, মৃণাল সেন, নবনীতা এবং অনেকেই। ‘এত মানুষ সুনীলকে ভালবাসে? ওদের তো সুনীলের থেকে কিছু পাওয়ার নেই, সুনীল চোখ খুলে দেখবে না, তবু এত লোক ভালবেসে শেষযাত্রায় এসেছেন, সুনীলের বন্ধু হিসেবে, বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে আমার সে দিন গর্ব হচ্ছিল,’ বলছিলেন নবনীতা। মৃণাল সেন নিয়ে এলেন দিকশূন্যপুরের কথা। ‘আলা রেনের মারিয়ানবার্গ, প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আর দিকশূন্যপুর পৃথিবীর কোনও মানচিত্রে নেই, আমাদের বুকের মধ্যে থাকে,’ বলছিলেন মৃণাল। রবীন্দ্রসদনের কোথাও বসেছিল কি দিকশূন্যপুরের বন্দনাদি বা আপ্পারাও? নীললোহিত কোনও দিন সেই কথা জানাবে না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় এবং ছেলে শৌভিকের হাতে নিজের
আঁকা সুনীলের পোর্ট্রেট তুলে দিচ্ছেন শিল্পী যোগেন চৌধুরী।
তপন রায়চৌধুরী নিয়ে এলেন ‘সেই সময়’, ‘প্রথম আলো’র কথা। ‘ইতিহাসের বিষয় একটিই। সেই সময় মানুষের কেমন লাগত? কেমন ছিল তার অনুভূতি?’ বলছিলেন তিনি। ইতিহাসবিদের ঐতিহাসিক উপন্যাস ভাল লাগবে, আশ্চর্যের নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘রাণু ও ভানু’ চমৎকার লেগেছে প্রবাসী ইতিহাসবিদের। বিভাস চক্রবর্তী জানালেন, নাটকের সঙ্গে সুনীলের ঘনিষ্ঠতার কথা। নাটক নিয়ে সুনীলের লেখালেখি, ‘রাজসভায় মাধবী’র মতো নাটক, বুধসন্ধ্যায় অভিনয় সবই উঠে এল সেই স্মৃতিচারণে।
কিন্তু এই স্মরণসভা তো শুধুই সেলিব্রিটিদের নয়। সুনীল পরজন্মে, আত্মায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর ভাইপো, ভাইঝিরা এ দিন তাঁকে নিয়ে কেউ শোনাল কবিতা, কেউ বা গান। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী অবশ্য একটা ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সুনীল ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, ঠিক। কিন্তু ধর্ম? ধর্ম মানে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক রিচ্যুয়াল নয়। তার আর একটি অর্থ, অন্যকে আঘাত না করা, অযথা কষ্ট না দেওয়ার নীতিবোধ। সেই অর্থে সুনীল অবশ্যই ধার্মিক।
কী এসে যায় ধর্ম-অধর্মের বোধে? অনুষ্ঠানে কৃত্তিবাসের কবিরা গেয়ে শোনালেন ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।’ সুনীলের তৈরি এই কবিতাপত্রিকা আগামী বছরেই পা দেবে ৬০ বছরে। সেই ‘তরুণ কবিদের মুখপত্র’র আদিযুগের শক্তি, তারাপদ রায়, সন্দীপনরা চলে গিয়েছেন অনেক আগে। আর পত্রিকার প্রাণপুরুষ? বহু পরে ‘কৃত্তিবাস’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে সাঁতরে সাঁতরে নিরুদ্দেশে’ চলে যাওয়ার কথা।
নিরুদ্দেশ? রাত নটায় স্মৃতি-তর্পণের পরই শেষ হয়ে যায় সব? এই তো, রাজপথ আলোয় আলোময়। রবিবারের কলকাতা, হু হু ছুটে যায় বাস। ওই তো পরিতোষ। ‘আত্মপ্রকাশ’-এর ভোরে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে, কাল রাত্রে আপনারা কোথায় ছিলেন? ‘সেই সময়’ এই রাস্তাতেই হেঁটে যেত মধু আর গৌরদাস। শহরের ‘লোনলি ক্রাউড’-এর ভিড়ে হেঁটে যায় ‘একা এবং কয়েক জন’।
জীবন থেমে থাকে না!

—নিজস্ব চিত্র
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.