প্রবন্ধ...
‘আমরা সবাই মালালা’
মিছিল করছে মেয়েরা। স্কুলকলেজের পড়ুয়া তারা। তালিবানদের অগ্রাহ্য করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে। হাতে পোস্টার: ‘আই অ্যাম মালালা।’ সম্প্রতি মালালা ইউসুফজাইয়ের ওপর হামলার পরে এই দৃশ্য দেখা গিয়েছে পাকিস্তানের নানা শহরে, মালালার বাসস্থান সোয়াট প্রদেশে, আফগানিস্তানেরও কিছু অংশে, সেখানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে পাখতুন মেয়ে লড়াই করেছিল, সেই মাইওয়ান্দের মালালাইয়ের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে মালালার। সাংবাদিকদের সামনে, ক্যামেরার সামনে মুখ খুলছে তার মতো স্কুলপড়ুয়া বহু মেয়ে। মিঙ্গোরা শহরে মালালারই খুশাল পাবলিক স্কুলের মেয়েরা বলছে, ‘‘সোয়াটে সব মেয়েই মালালা। আমরা লেখাপড়া শিখবই। আমরা জিতব। ওরা আমাদের হারাতে পারবে না।’’ পাকিস্তানে গবেষণা প্রতিষ্ঠান জিন্না ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা রাজা রুমি বলছেন, পাকিস্তানের নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলনে মেয়েদের বড় ভূমিকা বরাবরই ছিল, মালালার সমর্থনে রাস্তায় নামার ঘটনা সেই ধারারই প্রবাহ। মালালার ওপর আক্রমণের পর পাকিস্তানে ও বিদেশি পত্রপত্রিকায় যে কিশোরীদের সাক্ষাৎকার (ছবি বা নাম দিয়ে) বেরিয়েছে, তাতে স্পষ্ট, শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা তাদের কী ভাবে বাইরে এনেছে। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। আরুষা। স্কুলে ফরাসি বিপ্লবের কাহিনি পড়েছে সে। এবং বলেছে, ‘ও দেশে কৃষকদের কী অবস্থা ছিল? তবু হাল ছাড়েনি। লড়েছে, জিতেছে। আমরাও পারব।’
এই সাহসের মর্যাদা কি দিতে পারছে পাকিস্তান? শুধু পশ্চিমের পত্রপত্রিকাই নয়, পাকিস্তানের বিদ্বজ্জনদের একটা অংশও স্বীকার করেছেন, এই ‘মালালা-মোমেন্ট’কে এখনও কাজে লাগাতে পারেনি পাকিস্তান, না সরকার, না সেনা, না নাগরিক সমাজ। প্রেসিডেন্ট মুশারফ বা জারদারির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন ইসলামাবাদকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তা কোথায়? সেনাপ্রধান আশফাক কিয়ানি হাসপাতালে মালালাকে দেখে আসার পরে বিবৃতি দিয়েছেন, জঙ্গিদের কাছে সেনাবাহিনী নতিস্বীকার করবে না। ব্যস্, ওইটুকুই।
তালিবানের নামও করেননি তিনি! জারদারি বলে দিয়েছেন, তালিবানবিরোধী অভিযানের প্রশ্ন নেই, কারণ ‘‘আবেগে ভেসে লাভ নেই। বাস্তবটা বুঝতে হবে। বাঘের পিঠ থেকে নামতে না জানলে ওঠার সাহস দেখানোই উচিত নয়। আপনারা কি জানেন দেশে কতগুলো মাদ্রাসা আছে আর তাদের একজোট হতে কয় মুহূর্ত সময় লাগবে?’’ এক জন নড়বড়ে প্রেসিডেন্টের পক্ষে আর কী-ই বা সম্ভব ছিল? শুধু কি তিনি? পার্লামেন্টে তালিবানবিরোধী অভিযানের প্রস্তাবে ভিটো দেয় প্রধান বিরোধী দল নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ। মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট ছাড়া মালালার উপর আক্রমণের প্রতিবাদে মিছিল করার সাহস দেখায়নি। এক সাক্ষাৎকারে ইমরান খান বলেছেন, এই আক্রমণের নিন্দা করতে পারবেন না, দলের সমর্থকদের প্রাণ তো তাঁকে বাঁচাতে হবে। তালিবানের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি! সম্প্রতি দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে আমেরিকার ড্রোন হামলার প্রতিবাদে তালিবানের প্রত্যক্ষ সমর্থনে মিছিল করেছিলেন ইমরান।
শুধু তিনি কেন? মালালার ওপর আক্রমণের পর বিভিন্ন শহরে যত মিছিলই হয়ে থাক না কেন, আমেরিকার ড্রোন হামলার প্রতিবাদে কিন্তু তার কয়েক গুণ বেশি মানুষ পথে নেমেছিলেন বা নামবেন। এবং, এখানেই নতুন জটিলতা। মালালার ওপর আক্রমণের পর দেশের বৃহত্তম ধর্মীয় দল জামাত-এ-ইসলামি’র নেত্রী সামিয়া রাহিল কাজি মালালা, তার বাবা এবং মার্কিন বিশেষ দূত রিচার্ড হলব্রুকের ছবি পোস্ট করিয়ে প্রচার শুরু করেন, মালালা পশ্চিমি এজেন্ট। তালিবানও একই কাজ করে। জনমানসে এই সন্দেহটা কিছুটা ঢুকিয়ে দেওয়া অবশ্যই গিয়েছে যে, মালালা আসলে পশ্চিমী প্রচারের অস্ত্র, তার কার্যকলাপে আমেরিকার হাত রয়েছে।
এ-ও রটে যে, আমেরিকাই আক্রমণটি করিয়েছে, আরও ড্রোন আক্রমণের সুযোগ তৈরি করতে। দেশের একটা বড় অংশের আমেরিকা-বিরোধী আবেগকে অস্বীকার করে তালিবানের বিরোধিতা করার সুযোগ বা ইচ্ছে রাজনৈতিক দল বা সেনাবাহিনীর নেই। নাগরিক সমাজেরও কি আছে?
অথচ, মার্কিন ড্রোন হামলা বা সে হামলায় নিরীহ মানুষের মৃত্যুর প্রতিবাদ এবং তালিবানি অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দুইয়ের মধ্যে তো কোনও বিরোধ নেই। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজ দুটো প্রতিবাদই কেন একই সঙ্গে করতে পারেন না? ড্রোন হানার প্রতিবাদের পরিসর কেবল ধর্মীয় গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দেওয়া হবে কেন? তা করা হয়েছে বলেই ‘মালালা সি আই এ’র চর’ বা ‘আমেরিকার সুবিধা করে দিতেই এই হামলা চালানো হয়েছে’, এই ধরনের প্রচার চালিয়ে সহজেই জনমত গুলিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। এই প্রচারে যদি কোনও সত্যতা থাকে, তা হলেও আক্রমণকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া জরুরি। এবং, সাধারণ ভাবেই, তালিবান সহ গণতন্ত্রবিরোধী সমস্ত শক্তির বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের রুখে দাঁড়ানো জরুরি। মালালার সমর্থনে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ও প্রতিবাদ দেশের, বিশেষত শহরের শিক্ষিত, অধিকারসচেতন সমাজের, সামনে বড় সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করেছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলন তৈরির কোনও চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।
এটা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, গভীর উদ্বেগের কারণ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসেব অনুযায়ী, গত বছর পাকিস্তানে জঙ্গিরা আক্রমণ চালিয়েছিল দেড়শোটি স্কুলে। এ বছর সংখ্যাটা একশো ছুঁইছুঁই। পাকিস্তানেরই শিশু অধিকার রক্ষা সংস্থার হিসেব, উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তত ৬ লক্ষ শিশু এক বছর বা তার বেশি স্কুলে যেতে পারেনি জঙ্গিদের হুমকিতে। মালালার সাফ কথা: ‘‘নতুন প্রজন্মের হাতে পেন দেওয়া না হলে জঙ্গিরা তাদের হাতে বন্দুক তুলে দেবে।’’

জানুয়ারি, ২০০৯। তালিবানি শাসন চেপে বসছে পাকিস্তানের আফগান সীমান্তে, সোয়াট উপত্যকায়। বি বি সি পাকিস্তানের এক সাংবাদিক ওই অঞ্চলের মিঙ্গোরা শহরের কবি ও শিক্ষাবিদ জিয়াউদ্দিন ইউসুফজাইকে এমন কোনও শিক্ষিকার সন্ধান দিতে অনুরোধ করলেন যিনি তালিবান শাসনে থাকা সোয়াটের মেয়েদের যন্ত্রণাদীর্ণ দিনগুজরানের বিবরণ লিখবেন। কোনও শিক্ষিকা সে সাহস দেখালেন না। এগিয়ে এল মালালা। জিয়াউদ্দিনের মেয়ে। ক্লাস সেভেন, বয়স এগারো। বি বি সি-র উর্দু ওয়েবসাইটে ৩ জানুয়ারি প্রকাশিত হল ‘দ্য ডায়েরি অব আ পাকিস্তানি স্কুল গার্ল’ ব্লগের প্রথম কিস্তি। সারা পৃথিবী শুনল কী ভাবে সোয়াটের মেয়েদের স্বপ্নে হানা দেয় সামরিক হেলিকপ্টার এবং তালিবান, কী ভাবে স্কুল থেকে ফেরার সময় শোনে মৃত্যুর হুমকি, কী ভাবে গুঁড়িয়ে যায় একের পর এক মেয়েদের স্কুল। জনপ্রিয় হয় ব্লগ। বিখ্যাত হয় মালালা। নির্বাচিত হয় ইন্টারন্যাশনাল পিস প্রাইজের জন্য; পায় পাকিস্তান সরকারের দেওয়া প্রথম ইয়ুথ পিস প্রাইজ। তাকে নিয়ে তৈরি হয় একাধিক তথ্যচিত্র।
এবং টের পায় ঘাড়ের কাছে শ্বাস ফেলা মৃত্যুর উপস্থিতি। কিন্তু মালালা হার মানতে রাজি নয়। তার লড়াই জারি থাকে। শেষ পর্যন্ত ৯ অক্টোবর, ২০১২। গুলি ছুটে আসে। মালালা ইউসুফজাই মুহূর্তে দুনিয়া জুড়ে প্রসিদ্ধ হয়। এবং বন্দিত। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মালালা জীবনে ফিরেছে। তাকে অভিবাদন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.