ব্রিটেনের সতেরো বৎসর বয়সি যুবক একটি ‘অ্যাপ্লিকেশন’ আবিষ্কার করিয়াছেন, যাহা যে কোনও সংবাদকে ভাঙিয়া তিনটি সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদে বিধৃত করিবে। সংবাদের অতিরিক্ত মেদ বাদ পড়িবে। আবিষ্কর্তা নিক ডি অ্যালোইসিয়ো-কে ইতিমধ্যেই অসামান্য কম্পু-বুদ্ধিমান হিসাবে ভাবা হইতেছে, বড় বড় মানুষ তাঁহাকে অর্থসাহায্য করিতেছেন, যাহাতে যুগান্তকারী আবিষ্কারটি যথাযথ রূপে ভূমিষ্ঠ হয়। এই আবিষ্কার বর্তমানের এক অতি প্রকট ও প্রধান প্রবণতাকে সন্তুষ্ট করিতেছে। তাহা হইল, সংক্ষেপে জানিব। ছোট করিয়া বলো, চট করিয়া জানাও, জলদি বুঝাইয়া দাও। কোনও বৃহদায়তন পাঠ্যবস্তুর সারসংক্ষেপ করার চল ইদানীং বহু স্তরে পরিলক্ষিত। বিদেশে প্রায়ই ধ্রুপদী সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশ করিয়া যুবসমাজকে তাহার নিকটে আনার প্রয়াস চলে, বাইবেল হইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলি উৎকলন করিয়া তাহা সহজবোধ্য ভাষায় লিখিয়া বিলাইবার চেষ্টা ঘটে। এমনকী শেক্সপিয়রের নাটককে এসএমএস-বয়ানে প্রকাশ করিবার উদ্যোগও হইয়াছে। এখন মেল-এ কেহ প্রবল হাসি পাইলে লেখে ‘এল ও এল’, ‘লাফ আউট লাউড’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। বর্তমানে কেহ বলে না, ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে যায়েঙ্গে’ দেখিয়া আসিলাম। ‘ডিডিএলজে’-তেই কাজ চলিয়া যায়।
আজ মানুষের চলচ্ছবি চাই দেড় ঘণ্টায় সমাপ্য, ক্রিকেট ম্যাচ চাই কুড়ি ওভারে ফলাফল-প্রদায়ী, আর পাঠ্য প্রবন্ধ তো এক লাইনে গিলাইয়া দিলে ভাল হয়। কারণ হিসাবে বলা হয়, ইদানীং মানুষের হাতে সময় বেশি নাই। তাহার জীবন প্রবল গতিশীল হইয়া গিয়াছে, একটি বিষয়ে অধিক ক্ষণ লিপ্ত হইয়া থাকা অসম্ভব। কথাটিকে স্বতঃসিদ্ধ ধরিয়া লওয়া হয়। কিন্তু ইহার অর্থ কী? মানুষ অধিক কাজ করিতেছে, দেশের উৎপাদন হু হু করিয়া বাড়িতেছে, মানুষ বিনোদনে কম ও ফাইলপত্রে বেশি উৎসাহী হইয়া পড়িয়াছে? না কি আধুনিক মানুষ অধিকাংশ সময় কাটায় অনাবশ্যক মেল চেক করিয়া, মোবাইলে এসএমএস চেক করিয়া, মোবাইলে সহস্র খেলা খেলিয়া, কম্পিউটারে প্রচুর খেলা খেলিয়া, আন্তর্জালে প্রচুর মজাদার (ও তাহার কোনও কর্মের সহিত সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন) সাইট ঘাঁটিয়া, মল-এ উদ্দেশ্যহীন বেড়াইয়া, সর্বক্ষণ টিভি খুলিয়া বসিয়া থাকিয়া? মানুষের কাজ বাড়িয়াছে, না বহু ধরনের অকাজের দ্বার তাহার সম্মুখে খুলিয়া গিয়াছে? আসলে তাহার বিনোদনের উপকরণ এত অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়াছে, সব কয়টিকে ভোগ করিবার তাড়ায় সে কোনও কিছুতেই স্থিত হইতে পারিতেছে না। চিরকালই মানুষের মনোযোগের অভাব ছিল। আজ, কোনও বিষয় ভাল করিয়া জানার জন্য যে অনুশীলন ও অভিনিবেশ প্রয়োজন, তাহা এড়াইবার, বিষয়টির প্রতি নিষ্ঠ থাকিবার দায় হইতে নিষ্কৃতি পাইবার, একটি বিশাল অজুহাত তাহার হস্তে আয়ত্ত হইয়াছে। সে খুবই উৎসাহী ছিল রবীন্দ্রনাথের বৃহৎ উপন্যাসটি পড়িতে, কিন্তু এত কাজ আসিয়া পড়িল, নেট সার্ফ ও চ্যানেল সার্ফ করার তাড়ায় সে প্রথম পৃষ্ঠাটি পার হইতেই পারিল না। কেহ কি এমন সুবিবেচক নাই, ‘গোরা’টিকে চার লাইনে নামাইয়া দিবে ও কোটি কোটি কেজো মনুষ্যের চটজলদি জ্ঞানস্পৃহা মিটাইয়া সুনাম কুড়াইবে? ফাঁকিবাজ পল্লবগ্রাহী মানুষকে তুষ্ট করিতে তুখড় কারবারিরা সর্বদাই অজস্র ‘যুগোপযোগী’ খেলা লইয়া উপস্থিত। যুগটিকে প্রশ্ন করা নয়, অশিক্ষিত যুগের চাহিদা মিটাইয়া নিজ আখের গুছানোই তাহাদের কাজ। সংবাদ নির্বিশেষে, তাহার অন্তঃসার, বিষয়গুরুত্ব, লিখনভঙ্গি, যুক্তিবিন্যাস নিরপেক্ষ ভাবে বারোয়ারি হারে সব কয়টিকেই তিন অনুচ্ছেদে ভাঙিয়া দেওয়া অতি নির্বোধ ও উদ্ধত রসিকতার সমান। ব্লার্ব পড়িয়া মহাকাব্য বুঝা সমাজকে রসিকতাটি হ্লাদিত করিতেছে। কিন্তু এই শর্টকাট-প্রক্রিয়া সাংবাদিক ও পাঠক উভয়কে চূড়ান্ত অপমান করে। যে সমষ্টি নিজের অপমান বুঝে না, তাহাকে ‘হ.ভা.’ বলিলেই চলে। হতভাগ্য বলিবার দরকার নাই। |