পূর্ব ভারতে মহিষাসুর বধ হয়ে গিয়েছে দশ দিন হল। গুজরাতও দশ দিন গরবা নেচে এখন একটু ক্লান্ত।
উত্তর ভারতের বিভিন্ন জায়গায় এখনও রাবণ বধের চিহ্ন পাওয়া যাবে।
দেওয়ালির বাকি আর দশ দিন।
এর মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় উৎসবভারতীয় ক্রিকেটের ২০১২-১৩’র মরসুম।
আর অন্য বারের তুলনায় এই মরসুম নিয়ে যেন কৌতূহলের মাত্রা অন্য বারের থেকেও বেশি। আসলে প্রতি বছর অক্টোবর পেরিয়ে নভেম্বর পড়লেই যেন ক্রিকেটের ঢাকটা বাজতে শুরু করে। তা দলীপ ট্রফি হোক কী রঞ্জি ট্রফি কী ঘরের মাঠের ইংল্যান্ড-ভারত সিরিজ। আর দশ দিনের মধ্যেই দেশ চলে যাবে ধোনি-পিটারসনদের দখলে।
শীতকালের দুপুর, ইডেনে সচিনের স্ট্রেট ড্রাইভ, ক্রিকেট রোমান্টিকরা তো এই সময়ের জন্যই অপেক্ষা করে থাকেন।
আজকাল তো সারা বছর ধরে টি-টোয়েন্টি লিগ আর অনির্ধারিত ক্রীড়াসূচির ঠেলায় ক্রিকেট-সিজনের বাউন্ডারিটাই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সবার একই বক্তব্য, ক্রিকেটিয় শিডিউলের বারোটা বেজে গিয়েছে।
কিন্তু এটাই তো নতুনকে স্বাগত জানানোর সময়। আর তাই যদি হয়, তবে ক্রিকেটই বা বাদ থাকে কেন?
অনেক বছর পরে এই মরসুমের দিকে ফিরে তাকালে ক্রিকেট রোমান্টিকরা হয়ত বুঝতে পারবেন এই সিরিজের মাহাত্ম্য।
আর সেই প্রসঙ্গেই একটু নস্ট্রাডামুস- নস্ট্রাডামুস খেলে এই সিজনে ঘটতে পারে এমন পাঁচ ঘটনা তুলে ধরছি। |
দেশের মাঠে হোয়াইটওয়াশ
ইংল্যান্ডের মাটিতে ৪-০য় হোয়াইটওয়াশ হওয়াটা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের এক বড় দুর্ঘটনা। টেস্ট ক্রিকেটে এক নম্বরের মুকুটও ধূলিসাৎ হয়েছিল সেই সিরিজ থেকেই। এই রকমটা হওয়ার কিন্তু কোনও কারণই ছিল না। এমনকী আজও ভারতীয় ক্রিকেট টিমের সদস্যরা আলোচনা করে, হঠাৎ কী এমন হল যে টিম অত খারাপ পারফর্ম করল লর্ডস কী ওভালে। লজ্জা কাটানোর একটাই সমাধান। ঘরের মাটিতে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়াকে হারানো।
অস্ট্রেলিয়া তবু ভারতকে ফাইনাল ফ্রন্টিয়ারের আখ্যা দিয়েছিল। ইংল্যান্ড অবশ্য আজ অবধি ও রকম কোনও নাম দেয়নি। এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, ইংল্যান্ড এদেশে শেষ জিতেছে সেই ১৯৮৫তে। এখনকার অনেক ভারতীয় ক্রিকেটাররা তখনও জন্মায়ইনি। ইতিহাসের বোঝা যখন নেই, তা হলে শত্রুকে অহেতুক ভয় পাওয়ারও কারণ নেই।
যা ঘটতে চলেছে
ভারত ইংল্যান্ডকে ৩-০য় হারাবে। কেভিন পিটারসন একটা বড় সেঞ্চুরি করে একটাই টেস্টে হার বাঁচাবে। অস্ট্রেলিয়াকে ২-০য় হারাবে ভারত। একটা টেস্ট বৃষ্টির জন্য ভেস্তে যাবে।
তিন নম্বরের খোঁজে
রাহুল দ্রাবিড় যখন অবসর নেন, ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর অন্তত ভয়ের কোনও জায়গা ছিল না। তিনি কিন্তু অনেক বছর ধরেই বিরাট কোহলির কথা বলে আসছেন। এমনকী অনেকবার ঘরোয়া আলোচনায় খোলাখুলিও জানিয়েছেন এই বয়সেই কী সুন্দর ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন কোহলি।
দ্রাবিড়-লক্ষ্মণের বিদায়ের পরের এই সিজনে ভারতীয় টেস্ট টিমের তিন নম্বর স্লটের দিকে তাই সবার নজর থাকাটা স্বাভাবিক। কোহলি টেস্টে একটু নীচের দিকে তো রান করছেনই, চেতেশ্বর পূজারাও তিন নম্বরে ভালই সফল। কিন্তু পুরো পরিস্থিতিটাই বদলে যেতে পারে দ্রুত।
ভারতীয় ক্রিকেটের একটা মহলের ধারণা সচিনের প্রায় পেটেন্ট করে ফেলা চার নম্বর স্লটটা বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছে কোহলির জন্য। কোহলির আসল জায়গা কিন্তু তিন নম্বর। সেখান থেকে কোহলি অনায়াসে খেলাটা কন্ট্রোল করতে পারবেন তাঁর স্ট্রোক-প্লে দিয়ে। ঠিক যেমন বহু বছর ধরে রিকি পন্টিং করতেন অস্ট্রেলিয়ার জন্য। আর পূজারার যা ধৈর্য তাতে হয়তো ওর জন্য পাঁচ নম্বরই ঠিক জায়গা। টপ অর্ডার কোনও দিন খারাপ খেললে তখন কিন্তু পাঁচে পূজারাকে লাগবেই ইনিংস সামলাতে।
যা ঘটতে চলেছে
কোহলির খেলার ধাঁচটাই এমন, ওঁকে ব্যাটিং অর্ডারে ছ’ নম্বরের বদলে ওপরের দিকে নিয়ে আসার কথা উঠবেই। বিশেষ করে তিনি যখন লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করে ভাল সুযোগ পাবেন না। প্রথমবার তিন নম্বরে নেমেই সেঞ্চুরি করবেন। তা সত্ত্বেও রাহুল দ্রাবিড়ের অভাবটা কিন্তু থেকেই যাবে। |
ক্যান্সারের পাহাড় অতিক্রান্ত, কিন্তু টেস্ট ক্রিকেট
শেষ সিজনটা যুবরাজের কী অদ্ভুত কাটল। আর ওর ক্যান্সার থেকে নাটকীয় প্রত্যাবর্তন তো মডার্ন ইন্ডিয়ার অন্যতম রূপকথা। অনেক বছর ধরেই যুবরাজের লাকি নম্বর ১২। ডিসেম্বরের ১২ তারিখ চণ্ডীগড়ের সেক্টর ১২-য় জন্ম তাঁর। তাও ১২ নম্বর ওকে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের জায়গা পাকা করাতে পারেনি। এই বারো বছরে যুবরাজ মাত্র ৩৭টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন, যেখানে একদিনের ক্রিকেট খেলেছেন ২৭৪টি। এই মরসুমে কি টেস্ট টিমে নিয়মিত হতে পারবেন তিনি? সম্ভাবনা কিন্তু উজ্জ্বল। এতটা খাটতে সত্যি ওঁকে আগে কখনও দেখিনি আমরা। ফলও মিলছে হাতে-নাতে। কিছু করে দেখানোর খিদেই দলীপ ট্রফিতে তাঁকে এনে দিয়েছে ঝকঝকে এক ডাবল সেঞ্চুরি। এবার শুধু অপেক্ষা নিজের এই অসম্ভব ট্যালেন্টের জোরে ২০১২-১৩ মরসুমের টেস্ট টিমে জায়গা পাকা করা।
যা ঘটতে চলেছে
যুবরাজ আগামী আটটা টেস্টের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি সেঞ্চুরি করবেন। অন্তত একবার একা হাতে টেস্টের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ হবেন।
এ বার রঞ্জি ট্রফি নিয়েও হয়তো মাতবে দেশ
আচ্ছা, বলুন তো, আপনার শহরে রঞ্জি ট্রফি হচ্ছে এই খবরটা কি আপনি নিয়মিত রাখেন? আলবাত রাখেন না। এমনকী যখন আমরা জানতে পারি তখন সেই খেলার বোধ হয় আর দু’ ঘণ্টা বাকি থাকে। ডাই-হার্ড ফ্যানরা খবর রাখলেও সাধারণ লোকের কাছে দেশীয় টুর্নামেন্টগুলো যেন রাডারের বাইরে।
কিন্তু এই পরিস্থিতিও বদলাল বলে। হ্যাঁ, এবং এই সিজন থেকেই।
ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের জন্য স্টার চ্যানেলের সঙ্গে বোর্ডের নতুন চুক্তি হয়েছে। এবার থেকে অনেক ঝাঁ-চকচকে প্রেজেন্টেশনে দেখা যাবে রঞ্জি কী দলীপ ট্রফি। এবং তার সুবাদেই সবাই আশাবাদী, এবার কামব্যাক হতে পারে ঘরোয়া ক্রিকেটের।
সেই ধারা মেনেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার সময় ভিভিএস লক্ষ্মণ জানিয়েছিলেন হায়দরাবাদের হয়ে খেলা চালিয়ে যাবেন তিনি। ওদিকে মুম্বইয়ের হয়ে উদ্বোধনী ম্যাচে খেলছেন সচিন তেন্ডুলকর আর জাহির খান। একই ভাবে দিল্লির হয়ে রঞ্জি ইনিংস শুরু করেছেন বীরেন্দ্র সহবাগ, গৌতম গম্ভীর, বিরাট কোহলিদের মতো স্টার ক্রিকেটারেরা।
হ্যাঁ, এটা সবাই বোঝে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক শিডিউলের চাপে সব রঞ্জি ম্যাচে এই স্টারদের পাওয়া যাবে না। কিন্তু তাও এদের ভাল পারফরম্যান্স রঞ্জির জেল্লা অনেকটাই বাড়াবে। সাথে যদি ক্রিকেটাররাও দেখেন পুরো পৃথিবীতে ভারতীয় ডোমেস্টিক ক্রিকেট দেখানো হচ্ছে, খেলার মানও বাড়তে বাধ্য। তাতে উপকৃত হবে ভারতীয় ক্রিকেটই। কাঁহাতক আর আইপিএল নিয়ে এই পাগলামি, এই মাতামাতি ভাল লাগে বলুন!
যা ঘটতে চলেছে
আইপিএলের জ্বলজ্বলে ভাবটা মিইয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জি ম্যাচের মূল্যটা বাড়বে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও জোরদার হবে। এর ফলে পেশাদার ক্রিকেটাররা লাভবান হবেন।
একটা যুগের অবসান
ভারতীয় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিঃসন্দেহে কোহলি। তবে তিনি যতই ‘বিস্ময়বালক’ হোন না কেন, তেন্ডুলকরকে ছাড়া ভারতীয় ব্যাটিং অর্ডার আজও কল্পনা করা যায় না। ফ্যানদের কাছে ভারতীয় ক্রিকেট মানেই সচিন।
তবে সারা জীবন তো সচিন থাকবেন না। আর সে ইঙ্গিত কিন্তু তিনি নিজেই দিয়ে রেখেছেন। আগামী মরসুমেই যদি অবসর নেন, তখন কী হবে ভারতীয় ক্রিকেটের? খেলা কিন্তু চলতেই থাকবে, যেমন আগেও চলেছে।
তবে বিরাট একটা বদল হবেই। প্রতিপক্ষের একটা বড় চাপ নেমে যাবে। দর্শকদেরও উত্তেজনার একটা কারণ কমে যাবে। টিম-মেটদেরও এটা মাথায় ঢুকিয়ে নিতে হবে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ২৩ বছরের অভিজ্ঞতার কুশনটা আর মাথার নীচে নেই। মেলবোর্ন থেকে মুম্বই, কলকাতা থেকে কেপটাউন। সচিন ক্রিজে নামা মানেই এক প্রবল জনোচ্ছ্বাস। স্টেডিয়াম জুড়ে উন্মাদনা।
সেই ঝড় চিরদিনের জন্য শান্ত হয়ে যাবে। শোনা যাবে না স্টেডিয়ামের সেই চিৎকার। সচিন অবশ্য সেই চিৎকার খুব একটা মিস করবেন না। পার্লামেন্ট তো আছেই!
যা ঘটতে চলেছে
খুব ভাল হয় যদি দক্ষিণ আফ্রিকাতেও তেন্ডুলকরকে খেলতে দেখা যায়। কিন্তু সেটা বোধহয় হবে না। তত দিনে তিনি জেনে যাবেন তাঁর দল একটা ভাল হাতে পড়েছে। আর তাই হয়তো অস্ট্রেলিয়া হোম সিরিজ খেলেই অবসর নেবেন লিটল মাস্টার। |
(লেখক উইজডেন ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনের ম্যানেজিং এডিটর) |