|
|
|
|
‘হেডস্যারে’র বাঁশি বাজলেই স্কুলে ছুট |
অভিজিৎ চক্রবর্তী • ঘাটাল |
সকাল থেকে নানা কাজের মধ্যেও মন পড়ে থাকে বাঁশির আওয়াজের দিকে। আর আওয়াজ পেলেই ব্যস, পড়িমরি করে স্কুলের ব্যাগটা কাঁধে নিয়েই দৌড়। এ অভ্যেস আজকের নয়, প্রায় ১২ বছর ধরে এভাবেই সাদিচক প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রণয় ভট্টাচার্য স্কুলে যাওয়ার ডাক দেন গ্রামের পড়ুয়াদের। এমনকী অবসর নেওয়ার পরেও গ্রামবাসীদের ‘হেডস্যার’ রোজ স্কুলে যাওয়ার পথে একইভাবে বাঁশি বাজান।
২০০০ সালের গোড়াতে প্রণয়বাবু সাদিচক প্রাথমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষক হয়ে যোগ দেন। তখন স্কুলের পরিবেশ ছিল অন্যরকম। ছাত্রছাত্রীদের অনিয়মিত স্কুল আসা যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পর্যাপ্ত শিক্ষকও ছিল না। এছাড়া গ্রামে সবার বাড়িতে ঘড়ি বা মোবাইল না থাকায় স্কুলের সময়ও বুঝতে পারতেন না অনেকে। প্রণয়বাবু বলেন, “আমি যোগ দেওয়ার পর গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে সব জানতে পারি। সময় সমন্ধে অনেকেরই ধারনা ছিল না। স্কুলে যাওয়ার অভ্যাসও ছিল না কারও। ঠিক করি প্রতিদিন সবাইকে নিয়ম করে স্কুলে আনতে হবে। আমার কথায় অভিভাবকরাও সাহস পান। সেই থেকে স্কুলে আসার সময় বোঝাতে বাঁশি বাজানো শুরু।” কিন্তু একদিনেই সাড়া মেলেনি। প্রণয়বাবু বলেন, “প্রথমে সাড়া পাইনি। কিন্তু দিনকয়েক পরই বাঁশির গুণ বুঝতে পারি। ক্লাসে গিয়ে দেখি প্রায় নব্বই ভাগ পড়ুয়ারাই স্কুলে এসেছে। সেই শুরু।” |
|
বাঁশি বাজিয়ে স্কুলের পথে প্রণয় ভট্টাচার্য। —নিজস্ব চিত্র। |
ঘাটালের কাটানের বাসিন্দা প্রণয় ভট্টাচার্য গত ৩১ জুলাই অবসর নিয়েছেন। কিন্তু বাড়িতে তাঁর মন টেকেনি। অবসরের ঠিক পরের দিন থেকেই ফের সাদিচক স্কুলের ওই ‘হেডস্যার’ স্কুলে যাচ্ছেন। অভ্যাস মতো সাইকেলে নিমতলা পার হওয়ার পরেই বাঁশি বাজাতে শুরু করেন প্রণয়বাবু। আর এখনও হেডস্যারের বাঁশির শব্দ শুনে ছেলেমেয়েরা কেউ তাঁর পিছনে পিছনে, কেউ বা তাঁর সাইকেলের পিছন দিকটা ধরে ছুটতে থাকে। কিন্তু স্কুলে গেলেও এখন আর প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসেন না তিনি, বরং স্কুলে পৌঁছে দীর্ঘদিনের অভ্যাস মেনে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে স্কুলের চারদিক এবং প্রতিটি ঘরকে ঝাঁটা দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন। এমনকী নিয়ম করে মিড ডে মিলের কী তরকারি হচ্ছে-তাও জেনে নেন। আর ঠিক ১১টা বাজলেই এখনও হাজিরা খাতা নিয়ে ঢুকে পড়েন ক্লাস রুমে।
সাদিচক ও কোটালপুর গ্রামের ছেলেমেয়েরাই মূলত ওই স্কুলে পড়ে। ১৩২ জনের মধ্যে ১২০ জন ছাত্রছাত্রীই স্কুলে আসে এখন। বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা তনুশ্রী দাস (বাগ) বলেন, “আমিও প্রায় একই সময় স্কুলে যোগ দিই। তবে ওঁনার চেষ্টায় স্কুল আজ অনেক উন্নত হয়েছে। শ্রেণিকক্ষের অভাব নেই। স্কুলের বিল্ডিং হয়েছে। এমনকী অনেক সময় কাজ আটকে পড়লে প্রণয়বাবু নিজের উদ্যোগে টাকা চেয়ে স্কুলের উন্নয়নে সেই টাকা লাগিয়েছেন। শৌচাগার, একাধিক মনীষীদের মূর্তি প্রতিষ্টা, বাগান তৈরি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও ওঁনার অবদান ভোলার নয়।” প্রধান শিক্ষিকা আরও বলেন, “উনি আমাদের কাছে স্কুলে অভিভাবকের মত।” একই কথা স্কুলের সহ-শিক্ষক মৃনালকান্তি দোলই, অসীম কুমার দে, মনিকা সামন্ত, শ্যামল দাসদেরও।
কিন্তু এখন তো গ্রামের অভ্যেস বদলেছে। অবসরের পরেও এভাবে স্কুলে আসার প্রয়োজন কী? প্রণয়বাবু বলেন, “যতদিন স্কুলে আসব বাঁশি বাজিয়েই আসব। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে যা দেখে আসছি, তার পরিবর্তন দেখতে পারব না।” হেডস্যারের রুটিন না বদলানোয় এখনও স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রী জানেই না, তিনি অবসর নিয়েছেন। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী আসমিনা খাতুন এবং ছাত্র সুরজিৎ দোলই, সন্দীপ দোলইয়েরা বলেন, “প্রণয়বাবুই আমাদের হেডস্যার।” স্থানীয় বাসিন্দা বলরাম কপাট, হরিপদ কপাটেরা বলেন, “এত বছর ধরে দেখছি উনি স্কুলে আসার পথে বাঁশি বাজিয়ে ছেলেমেয়েদেরর ডাক দেন।” গ্রামেরই বনমালি দোলই, সনাতন রায়, ঝন্টু ঘাঁটিরা বলেন, “উনি শুধু চাকরির দায়েই স্কুলে আসতেন না, স্কুল এবং ছাত্রছাত্রীদের জন্য অন্য টান ছিল। অবসরের পরে ফের স্কুলে আসাতেই তা প্রমান হয়ে যাচ্ছে।” সম্প্রতি রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ‘শিক্ষারত্ন’ পেয়েছেন প্রণয়বাবু। এখন ওই স্কুল শুধু সাদিচক নয় পাশাপাশি গ্রামেরও অহঙ্কার। |
|
|
|
|
|