ব্যাগ গুছিয়ে...
ডাকে চাঁদের পাহাড়
ঙ্করও ওখানে গিয়েছিল। ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর। যে ‘চাঁদের পাহাড়’ বাঙালির শিরায় শিরায় অ্যাডভেঞ্চার বুনে দিয়েছে বহু কাল ধরে। আমারও মননে তাই ঘাঁটি গেড়ে বসেছে সেই মহাদেশ, আফ্রিকা। সেই অপ্রতিরোধ্য সুদূরের ডাকে সাড়া না দিয়ে কি পারা যায়? কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে গন্তব্য তাই কেনিয়া।
উদ্দেশ্যটা ছিল একটু অন্য রকম। শুধু বেড়ানো নয়। সেই অচেনা দেশটার গলিঘুঁজি বা বলা ভাল, আদাড়েবাদাড়ে হানা দিয়ে মুভি ক্যামেরায় তুলে আনা যাবে সবটা। চলমান ছবির সুতোয় গেঁথে ফেলা যাবে সামবুরু, নাকুরু আর কিলিমাঞ্জারো-কে। কে বলতে পারে আমার চোখে দেখা কেনিয়াই হয়তো হয়ে উঠবে একটা গোটা তথ্যচিত্রের বিষয়! তাই যখন প্রথম পা রাখলাম নাইরোবির জোমো কেনিয়াত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটিতে, উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম, নাইরোবিতে নেমেই বুঝি সিংহ দেখতে পাব! আসলে আফ্রিকা নিয়ে আম-বাঙালির মনের ভাব অনেকটা এ রকমই। কিন্তু বলা বাহুল্য, সে আশা তো আর পূর্ণ হয়নি। দিব্যি ঝাঁ-চকচকে একটা শহর। বড় বড় শপিং মল। হাইওয়ে দিয়ে দামি-দামি সব গাড়ি ছুটে চলেছে। মনটা একটু কেমন-কেমন করছিল। তবে নাইরোবি শহরটায় এক চক্কর দিয়ে আসল সফর শুরু হল সামবুরু গেম রিজার্ভ থেকে।
কেনিয়ার ‘জঙ্গল’টা বেশ অন্য রকম। সেখানে বঙ্গদেশের মতো আদিম বনানী নেই। নেই আকাশছোঁয়া মহীরূহের সারি। বদলে রয়েছে আদিগন্ত ধূ ধূ রুক্ষ প্রান্তর। মাঝে মাঝে ছোট ঝোপ অথবা অদ্ভুত চেহারার বাওবাব গাছ। বাওবাব! শুনলেই কেমন গায়ে কাঁটা দেয়, তাই না! আবার মনে পড়ে যায় শঙ্করের কথা। কাজেই সেই দিগন্তবিস্তৃত খোলা জায়গায় চোখ বাধা পায় না। বন্যেরা সহজেই ধরা পড়ে দৃষ্টিপথে। তাই যেখানেই ক্যামেরা বসান, সেখানেই আফ্রিকা রসদের ঝুলি উপুড় করে দেবে আপনার সামনে।
আচ্ছা, আপনি তো এখন আলিপুর চিড়িয়াখানায় নেই! বাড়িতে বসে টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকও দেখছেন না। যাচ্ছিলেন বেশ গাড়ি চেপে, নতুন জায়গায় এসে মনটাও ফুরফুরে। হয়তো স্থান-কালের মাহাত্ম্যটা ভুলেই গিয়েছিলেন। হঠাৎ চোখের সামনে দেখলেন জিরাফের মতো দেখতে একটা লম্বাগলার প্রাণী দিব্যি নির্ভয়ে গাছের উঁচু ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে। আরে! এটা তো জিরাফই। সে দিক থেকে চোখ ফেরাতেই দূরে দেখা যায়, একরাশ সাদা-কালো জেব্রা!
বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই পথ আটকে গজেন্দ্রগমনে রাস্তা পেরোল ম্যামথের নবতম সংস্করণ এক ভীষণদর্শন হস্তি। তাই দেখে বাওবাব গাছের ডালে হেসেই কুটোপাটি হচ্ছে বেশ কয়েকটা বেবুন। আর সকলের কাছেই ক্যামেরা বস্তুটা দিব্যি পরিচিত। তার ফ্ল্যাশের ঝলকানিও। ক্যামেরা উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ানো সবেতেই বিস্ময়ে হতবাক ট্যুরিস্টদের পাত্তাও দেয় না এরা। তা সে সুদৃশ্য শিঙের বাহার নিয়ে ছুটে বেড়ানো হরিণই হোক, বা অলস দুপুরে বিশ্রামরত রাজকীয় সিংহী অথবা সামবুরু আর মাসাই উপজাতির রমণী ও শিশুরা। বছর তিনেকের ছোট্ট মাসাই শিশু, ভাল করে কথাও ফোটেনি মুখে। অথচ ট্যুরিস্ট দেখলেই সে সহজাত ভাবে বলে ওঠে ‘জাম্বো’, অর্থাৎ কি না ‘ওয়েলকাম’। হ্যাঁ। এর নামই আফ্রিকা।
আমাদের গন্তব্যের তালিকায় রয়েছে সামবুরু গেম রিজার্ভ, রিফ্ট ভ্যালি, লেক নাকুরু ন্যাশনাল পার্ক, সুইট ওয়াটার গেম রিজাভর্র্ আর অ্যাম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্ক। রিফ্ট ভ্যালির রাঙা মাটি দেখলে মনে পড়ে যায় বীরভূমের কথা। মোলাকাত হয়েছে ‘বিগ ফাইভ’দের সঙ্গে। ‘বিগ ফাইভ’ অর্থাৎ সিংহ, চিতা, লেপার্ড, গন্ডার, কেপ বাফেলো। সুইট ওয়াটারে ঘুরতে গিয়ে হয়েছে আর এক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা।
রাতের ঘন অন্ধকারে দুঃসাহসে ভর করে ক্যামেরাবন্দি করে ফেলেছি চিতার হরিণভক্ষণ। গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম অকুস্থলের একদম কাছে। প্রাণের মায়া না করে আলো ফেলেছিলাম ব্যাপারটা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখতে। ভাগ্য ভাল, হরিণখাদক উপেক্ষা করেছে আমাদের। উচ্ছিষ্ট পাওয়ার আশায় আশপাশে ওঁৎ পেতে বসে থাকা শিয়াল-হায়নার দল আর ক্যামেরা তাক করে থাকা বঙ্গসন্তান দু’টোই তার কাছে ফালতু। কাজেই সামবুরুর মতোই সুইট ওয়াটার ন্যাশনাল পার্কের অভিজ্ঞতাটাও নেহাৎ মন্দ হয়নি।
এ বার চলে এসেছি লেক নাকুরুতে। সেখানেও যথারীতি চমকের শেষ নেই। কত বিচিত্র পাখি! পেলিক্যান, ফ্লেমিঙ্গো, ক্রেক, হ্যামারকপ, হাডাডা, ইয়েলো নেক্ড স্পারফাউল, রেড বিল্ড হর্নবিল, গিনি ফাউল, গ্রে ক্রাউন্ড ক্রেন, অস্ট্রেলিয়ান আইবিস, আফ্রিকান স্যাক্রেড আইবিস কত বলব! বাকিদের তো নামও জানি না। তাদের নির্ভীক ঘাড় উঁচু করে জলবিহার আর অপূর্ব ছন্দে জল ছিটিয়ে ডানা ঝাড়া দেখে মনে পড়ে যায় বহু কাল আগে দেখা এক অসাধারণ ডক্যু-ছবির কথা ‘উইঙ্গড মাইগ্রেশন’। সুপার্ব স্টারলিং-এর মতো কেউ কেউ আবার সব বাধা ভুলে উড়ে এসে বসে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে। তাদের রঙিন ডানার একটুখানি নীল লেগে থাকে জানলার কাচেও।
ট্যুরিস্টদের গাড়ি ছুটে চলে এক অজানা থেকে আর এক অজানার দিকে। আর আফ্রিকা ধীরে ধীরে মেলে ধরে তার স্বরূপ। রিফ্ট ভ্যালির উপরেই পরের বিস্ময় অ্যাম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্ক! আর অ্যাম্বোসেলির অন্যতম আকর্ষণ মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো। কিলিমাঞ্জারোর কথা ভূগোল বইয়ে কত পড়েছি! আর এখন সে চোখের সামনে! দূরে আকাশের গায়ে মিশে থাকা অর্ধচন্দ্রাকৃতি সেই আগ্নেয়গিরি এখন শান্ত। লাভাস্রোতের আশঙ্কা নেই। শুধু অভয়ারণ্যের হাতি-সিংহ-হায়েনা-চিতাদের প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে দীর্ঘ কাল। মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় তার চূড়াকে। কিলিমাঞ্জারো-কে দিগন্তে রেখে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে আবার নাইরোবির দিকে।
হপ্তা দু’য়েকের সফর ফুরিয়ে আসে। তবু আফ্রিকা ভীষণ ভাবে রয়ে যায় স্মৃতিতে। মনের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকে টুকরো টুকরো মণিমুক্তো। সারে সারে ভিড় করে আসে সামবুরুর বন্যপ্রাণীরা, লেক নাকুরুর পাখিরা, অ্যাম্বোসেলি, মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো আর মাসাই-সামবুরু আদিম উপজাতির মানুষেরা। হোক না তারা স্যাটেলাইট চ্যানেলের যুগে আমার পূর্বপরিচিত, লাগুক না তাদের প্রাগৈতিহাসিক জীবনযাত্রায় বিশ্বায়নের ছোঁয়া! তবুও তো এরা চিরনতুন, পলকে পলকে রোমাঞ্চিত করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এরা। তাই আফ্রিকার অলিতে-গলিতে আজ আর শঙ্করকে খুঁজে না পেলেও আমার চোখে দেখা আফ্রিকা অনন্য, একেবারে অন্য রকম।

কী ভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে সরাসরি নাইরোবি যাওয়া যায় না। কলকাতা থেকে মুম্বই গিয়ে তার পরে কেনিয়া
এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে যেতে পারেন নাইরোবি। এখন কেনিয়ার সামবুরু, নাকুরু, অ্যাম্বোসেলি, মাসাইমারা
যাওয়ার জন্য নানা রকম প্যাকেজের ব্যবস্থা করে বিভিন্ন সংস্থা। বেসরকারি বিভিন্ন থাকার জায়গা রয়েছে।
জ্ঞাতব্য বিষয়
কেনিয়া যাওয়ার আগে নিতেই হবে ‘ইয়েলো ফিভার’-এর ইঞ্জেকশন। না হলে ঢুকতেই পারবেন
না নাইরোবিতে। কলকাতা বিমানবন্দর থেকেই এই ইঞ্জেকশন নেওয়া যায়। এ ছাড়া, পাসপোর্ট, ভিসার
ব্যবস্থা আগে থেকে করে নেওয়া ভাল। পুরো সফরটায় পাসপোর্ট কখনও কাছছাড়া করবেন না।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.