সেই শেষ পর্যন্ত মদন মিত্রকে দিয়া বলাইতেই হইল, এত বার ডিজেলের দাম বাড়িলে বাসভাড়া না বাড়াইয়া উপায় থাকে না। সেই বাজার অর্থনীতির প্রাথমিক সূত্রটিকে স্বীকার করিতেই হইল। কিন্তু, বিস্তর জল ঘোলা করিবার পর। রাজ্যবাসীকে মাসতিনেকের পরিবহণবিপর্যয় ভোগ করিতে বাধ্য করিবার পর। ইহার পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থনীতির যুক্তির মাহাত্ম্য বুঝিবেন, তেমন আশা কম। তবে, মা-মাটি-মানুষের যে অংশের এখনও কাণ্ডজ্ঞান খানিক অবশিষ্ট আছে, তাঁহারা বিলক্ষণ বুঝিবেন, ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করার কু-অভ্যাসে অকারণ কালক্ষেপ ছাড়া আর কোনও লাভ নাই। অতএব, মুখ্যমন্ত্রীর পরের ‘জেদ’-এর সময় রাজ্যবাসী তাঁহাকে এই কথাটি স্মরণ করাইয়া দিতে পারেন।
প্রতি যাত্রায় একটি টাকা বেশি দিতে মানুষের যতখানি কষ্ট হয়, বাস না পাইলে কষ্ট তাহার তুলনায় ঢের বেশি। বিকল্প বলিতে অটোরিকশা। তাহার ভাড়া বাসের তুলনায় এমনিতেই বেশি, রক্তচক্ষু চালকরা নিয়মিতই আরও বেশি দাবি করেন এবং পাইয়া থাকেন। ফলে, মুখ্যমন্ত্রী বাসভাড়া না বাড়াইবার যে ধনুর্ভঙ্গ পণ করিয়াছিলেন, তাহাতে মানুষের স্বার্থরক্ষা কতখানি হইতেছিল বলা মুশকিল, নিশ্চিত ভাবেই নাভিশ্বাস উঠিতেছিল। বাসভাড়া না বাড়াইয়া যে গত্যন্তর নাই, এই কথাটি প্রত্যেকে বুঝিয়াছিলেন। এক জনই ব্যতিক্রম। কোনও কোনও এলাকায় যাত্রীরাই উদ্যোগ করিয়া বাসভাড়া বাড়াইয়া দিয়াছিলেন। বাসমালিকদেরও তো খাইয়া-পরিয়া বাঁচিবার অধিকার থাকা উচিত। বাসভাড়া না বাড়াইলে একমাত্র বিকল্প ছিল রাজকোষ হইতে তাঁহাদের ভর্তুকি দেওয়া। ভাড়া বাড়ানোই যে অপেক্ষাকৃত সহজ, মুখ্যমন্ত্রী বহু বিলম্বে বুঝিলেন। আর এক উপায়ে বাসভাড়া অপরিবর্তিত রাখা যাইত যদি তিনি ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি রোধ করিতে পারিতেন। কিন্তু কলিকাতা অচল করা মিছিলের ডাক দিয়া তো তাহা সম্ভব নহে। তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমে-বাড়ে। তাঁহার যদি সেই বাজারকে প্রভাবিত করিবার ক্ষমতা থাকে, করুন। নচেৎ, ইহাই উপায়।
আর পাঁচটি ক্ষেত্রের ন্যায় বাসভাড়ার প্রশ্নেও মুখ্যমন্ত্রী নিজের বিপদ নিজে ডাকিয়াছেন আগ বাড়াইয়া কথা বলিয়া। কোনও যুক্তি-তর্ক, কোনও পাটিগণিতের ধার না ধারিয়া তিনি ভাড়া না বাড়াইবার জেদটি রাষ্ট্র করিয়া দিলেন। প্রকাশ্যে সেই কথা গেলাও বিপদ, আবার জেদে অটল থাকিলে রাজ্য চলে না। জমির ক্ষেত্রেও মুখ্যমন্ত্রী একটি কাণ্ড করিয়াছেন। তবে বাসভাড়ায় তাঁহাকে কেন্দ্রীয় সরকার বাঁচাইয়া দিয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের দায় তিনি পূর্বেও লইতেন না এখন তো তাঁহারা ঘোষিত শত্রু। তেলের দাম কেন্দ্রীয় সরকার বাড়াইয়াছে, ফলে বাসভাড়া বাড়াইবার দায়টিও তাহার ঘাড়ে চাপাইয়াই এই যাত্রা নিস্তার মিলিয়াছে। জেদ-এর বোঝা আর বহিতে হয় নাই। শুধু একটিই প্রশ্ন: সরকার ছাড়িবার পরও দেড় মাস কাটিয়া গিয়াছে। বাসভাড়া আর দিনকয়েক পূর্বে বাড়াইলেই বা ক্ষতি কী ছিল? |