চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
শিল্পীর চেতনায় প্রতিফলিত হয় শুধুই প্রকৃতি
নিতা রায়চৌধুরী তাঁর ছবিতে প্রকৃতির অন্তর্লীন সুরটিকে ধরতে চান। গ্যালারি ৮৮তে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর একক প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর স্মারকপত্রের ভূমিকায় তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ‘মাই পেইন্টিংস আর নাথিং বাট ভয়েস অব নেচার’। প্রকৃতির বাইরের স্বাভাবিক রূপ নয়, ভিতরের স্পন্দনকে রূপ দিতে চান তিনি। এই রূপায়ণের ভিতর দিয়ে প্রকারান্তরে উঠে আসে তাঁর চেতনায় প্রতিফলিত প্রকৃতির প্রতিভাস। শিশুর মতো সারল্যময় দৃষ্টি মেলে রাখেন তিনি। সেই সারল্যে প্রকৃতি রূপান্তরিত হয়। বিমূর্তায়িত হতে থাকে। যদিও সম্পূর্ণ নিরবয়বের দিকে যায় না। প্রকৃতির ভিতর এই আত্মপ্রক্ষেপ অনেকটা প্রতিচ্ছায়াবাদী বা ইম্প্রেশনিস্ট দর্শনের সমগোত্রীয়। সেই সঙ্গে ‘নাইভিটি’ বা শৈশব-সারল্যের একটা মাত্রা যেহেতু তাঁর ছবিতে থাকে, তাই কিছু অভিব্যক্তিবাদী অনুভবও সম্পৃক্ত হয়ে যায় এর ভিতর। তাঁর দীর্ঘ সাধনায় এ সমস্ত আঙ্গিক-প্রস্থানের বৈশিষ্ট্যকে তিনি সমন্বিত করে নেন ঐতিহ্যদীপ্ত দেশজ প্রবহমান প্রজ্ঞার সঙ্গে। এ দিক থেকে বিনোদবিহারী, রামকিঙ্কর, গোপাল ঘোষের পরম্পরার একজন উত্তরসাধক হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা যায়। যদিও কারওরই সুস্পষ্ট প্রভাবের মধ্যে অবরুদ্ধ হয়নি তাঁর ছবি।
অনিতা রায়চৌধুরী ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত একজন শিল্পী। ষাটের দশকের শিল্পীদের মধ্যে, এই বাংলায় অন্তত, মহিলা শিল্পীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। যাঁরা একসঙ্গে শুরু করেছিলেন সেই সময়, তাঁদের অনেকেই মাঝপথে থেমে গেছেন। জীবনের নানা দায় বহন করতে গিয়ে সৃজনের ক্ষেত্রে তাঁরা সব সময় সক্রিয় থাকতে পারেন না। সেই প্রজন্মে এ রকমই ঘটেছে বেশি। এখন অবশ্য পরিস্থিতি পাল্টেছে। ১৯৯০-এর পর থেকে মহিলা শিল্পীরা অনেক বেশি সক্রিয়। ষাটের দশকের প্রেক্ষাপটে অনিতা ব্যতিক্রম। শিল্পের দায়কে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তাই তাঁর যাত্রা কখনও স্তিমিত হয়নি।
শিল্পী: অনিতা রায়চৌধুরী
১৯৬০-এ তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করেন। সে বছরই ‘সোসাইটি অব কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস’ দলের সদস্য হন। ১৯৬৯-এ যোগ দেন ‘ক্যালকাটা পেইন্টার্স’ দলে। প্রথম পর্বে তাঁর ছবিতে স্বাভাবিকতার দিকে ঝোঁক ছিল। সেটা হয়তো আর্ট কলেজে অ্যাকাডেমিক রীতিতে প্রশিক্ষণের জন্য। কিন্তু কিছু পরে জীবনের টান, ঐতিহ্যের টান তাঁকে নতুন পথের সন্ধানে ব্যাপৃত করেছে। সেটাকে কি ‘রোমান্টিক’ বলা যেতে পারে? রোমান্টিকের নানা বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দু’টি মাত্রাকে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করা যায়। একটি প্রতিষ্ঠিত গতানুগতিক পথ সম্পর্কে অতৃপ্তি। ধ্রুপদী প্রকাশভঙ্গির বিপরীতে এক প্রতিবাদী চেতনা জাগিয়ে রাখা। দ্বিতীয়টি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে স্বাভাবিকের ভিতরে অলৌকিক আলোর সন্ধানের প্রয়াস। অনিতা তাঁর নিসর্গ-ভিত্তিক রূপায়ণে এই দ্বিতীয় পথটির সন্ধান করেছেন। জীবনকে তিনি অতৃপ্তি বা সংশয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেননি। তাঁর মানবীচেতনা তাঁকে এক চিরায়ত প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেই প্রেমের দৃষ্টিতে তিনি জীবন ও প্রকৃতিকে দেখেছেন। অনিতার ছবিতে রেখার সুরেলা বিন্যাস, তার জঙ্গমতা, কোমলতা, স্নিগ্ধ আলোকদীপ্তি এ সমস্তের ভিতর যে ভালবাসার স্পন্দন থাকে, তাকে মানবীচেতনার প্রকাশের বৈশিষ্ট্য বলে চিনতে অসুবিধা হয় না।
আলোচ্য প্রদর্শনীর ছবিগুলির অধিকাংশই বর্ণ-সম্পৃক্ত ড্রয়িংধর্মী। তেলরং আছে, জলরং-প্যাস্টেল ভিত্তিক মিশ্রমাধ্যমও আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃতি হয়ে উঠেছে প্রকৃষ্ট প্রস্থানবিন্দু। সেই স্মৃতিকে শিল্পী রূপান্তরিত করেছেন। অনেক সময় বিষয়কে স্পষ্ট করে চেনাও যায় না। কখনও কখনও বিষয়টি থাকে। তবে অবয়বীসত্তার ভিতরের স্পন্দনটিকে তিনি বের করে আনেন। ক্যানভাসের উপর তেলরঙে আঁকা একটি স্টিল লাইফ ছবি যেমন। ফুলদানিতে ফুল রয়েছে। পাশে বসে আছে একটি পাখি। প্রেক্ষাপটে হাল্কা রং ও রেখার কারুকাজ। ফুলদানিটি উপলক্ষ মাত্র। অব্যক্ত একটি সৌন্দর্যের স্পন্দনকে ধরাই যেন শিল্পীর লক্ষ্য। আবার ‘আকাশ পথে’ শীর্ষক ছবিতে বিমানে যেতে যেতে যে ভাবে নীচের দৃশ্য ধরা পড়েছে তাঁর চোখে, রেখার জালিকায় তাকেই ধরার চেষ্টা করেছেন। একই বৃন্তে ফুটে থাকা তিনটি ফুল নিয়ে এঁকেছেন একটি ছবি। পাশে রয়েছে আরও একটি ফুল। ভূমিতে চোখ মেলে থাকা একটি পাখি। এখানে বিষয়ের যে স্পষ্টতা আছে, সে রকম স্পষ্টতা থাকে না সব ছবিতে। মূর্ত ও বিমূর্তের দুই প্রান্তের মধ্যে আন্দোলিত হতে হতে শিল্পী তাঁর নিজস্ব ধ্যানেরই এক অরূপ মূর্তি যেন উদ্ভাসিত করতে চান।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.