ওঁরা ডুবুরি নন। কিন্তু ডুব দিতে জানেন।
ওঁরা নৌকা চালাতে জানেন। কিন্তু ওঁদের কেরামতি শুরু হয় নৌকা ডুবে যাওয়ার পরে।
পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকে না। কিন্তু এক দমে ডুব দিয়ে নদীর নীচ থেকে ওঁরা দেখে আসতে পারেন তলিয়ে যাওয়া নৌকার খোল। খাঁজে-খোঁজে আটকে থাকা লাশও।
এই করতে করতেই কখন যেন এক বাঁধনে বাঁধা পড়ে গিয়েছেন ছ’জন। কাটোয়ার বাবলাডাঙা গ্রামের চৌধুরীপাড়ার রূপচাঁদ চৌধুরী, শ্রীজল চৌধুরী, ভুনুয়া চৌধুরী, রামদেব চৌধুরী, জয়রাম চৌধুরী ও বাঘা চৌধুরী। মুখে মুখে গল্প ছড়াতে ছড়াতে লোকেও জেনে গিয়েছে ওঁদের কথা। ডাক পড়েছে সুদূর বাংলাদেশ থেকেও।
শুরুটা হয়েছিল প্রায় দু’দশক আগে। বছর পাঁচেক আগে বাংলাদেশের আখরিগঞ্জের মোলডাঙা ঘাটে নৌকা ডুবে যায়। ডাক আসে ছ’জনের। ডুব দিয়ে দলের তলায় নৌকায় দড়ি বেঁধে পাড়ে শক্ত গুঁড়ি পুঁতে টেনে নৌকাটি উদ্ধার করেন তাঁরা। বছর দুয়েক আগে কাটোয়ার ভাগীরথীতে গরু-সহ একটি নৌকা জলে পড়ে যায়। নৌকাটি তুলে এনেছিলেন তাঁরাই। পূবস্থলীর পাটুলির ঘাট থেকে নৌকায় একটি ট্রাক্টর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল পাখিরচর এলাকায়। মাঝ ভাগীরথীতে নৌকা উল্টে যায়। দলনেতা রূপচাঁদের কথায়, “ভাগীরথী থেকে ট্রাক্টর তুলতে ক্রেন আনা হয়। কিন্তু ট্রাক্টরটি তোলা সম্ভব হয়নি। উল্টে যাওয়া ট্রাক্টরের চাকায় দড়ি বেঁধে পাড়ে তোলা হয়।” |
শুধু কি নৌকা উদ্ধার নিখোঁজ দেহ উদ্ধারেও তাঁদের জুড়ি মেলা ভার। মাস দেড়েক আগে পাটুলির এক ব্যবসায়ী স্কুলমাঠ এলাকায় ভাগীরথীতে নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁদের প্রচেষ্টায় ওই ব্যবসায়ীর দেহ মেলে। সম্প্রতি পাটুলির ভকতপাড়া ঘাটে স্নান করতে গিয়ে ভাগীরথীতে তলিয়ে যায় চার জন স্কুল পড়ুয়া। তাদের খোঁজে শুরু হয় প্রশাসনিক তৎপরতা। স্থানীয় সাহেবতলা থেকে নিয়ে আসা হয় স্পিড বোট ও ডুবুরি। বহু চেষ্টাতেও খোঁজ মেলেনি তাদের। পরের দিন ভোরে খবর যায় তাঁদের কাছে। সকাল ১০টা নাগাদ কাজে লেগে পড়েন ওই ছ’জন। প্রায় এক ঘণ্টার চেষ্টায় রূপচাঁদের নেতৃত্বে ৪০ ফুট গভীর থেকে তুলে আনা হয় পর পর তিনটি মৃতদেহ। পাড়ে উঠে রূপচাঁদ সে দিন জানিয়েছিলেন, অন্য দেহটা অনেক দূরে চলে গিয়েছে। কাছাকাছি নেই। পরের দিন ভকতপাড়া থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বেলেরহাটে ভেসে ওঠে লাশটি।
ভাগীরথীর ভাঙন রোধের জন্য বাঁশের খাঁচা ফেলা হয়েছিল জলের নীচে। তাতেই আটকে গিয়েছিল মৃতদেহগুলি, জানান রূপচাঁদবাবু। মাসখানেক আগে জলের তলা থেকে নতুনপাড়া এলাকার এক মহিলার দেহও একই ভাবে উদ্ধার করা হয়েছিল বলে জানান তিনি। এছাড়াও নদীতে তলিয়ে যাওয়া সোনা রুপোর গয়নাও উদ্ধার করতে তাঁদের ডাক পড়ে। রামদেব বা জয়রামের কথায়, “ছোট থেকে ভাগীরথীতে মাছ ধরা বা নৌকা বাওয়া, জলের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন গভীর হয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ জলে ডুবে থাকার অভ্যাস তৈরি হয়েছে।” দিন তিনেক আগেও পূর্বস্থলী ২ ব্লকের ঝাউডাঙা গ্রামে ভাগীরথীতে ডুবে যাওয়া একটি নৌকা উদ্ধার করেন তাঁরা। শ্রীজলের কথায়, “অনেক সময়ে ডাকের অপেক্ষা করি না। কোনও ভাবে খবর পেলে নিজেরাই ছুটে যাই।”
পাটুলি পঞ্চায়েতের মামুদপুর এলাকার বাসিন্দা প্রশান্ত হালদার বলেন, “ভাগীরথীতে কোনও বিপদ হলে ওঁরাই সহায়। এলাকার সবাই ওঁদের চেনে। প্রশাসনের উচিত ওঁদের স্বীকৃতি দেওয়া।” তাঁদের কথা জানেন পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, “ভকতপাড়ায় ওঁরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। দুর্যোগ মোকাবিলার কাজেও যাতে ওঁদের ব্যবহার করা যায়, সে ব্যাপারে মহকুমাশাসককে জানানো হবে।”
এমনিতে মাঠে চাষ করে, নৌকা চালিয়েই দিন কাটে ওঁদের। শ্রীজলই শুধু উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ। বাকিরা কেউ প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডিও পেরোননি। কিন্তু কোনও প্রত্যাশা নেই ওঁদের। শ্রীজলবাবুর কথায়, “কাজের জন্য পারিশ্রমিক! কখনও নিই না। তবে কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে নিই।” |